অনলাইন ডেস্কঃ
দেশ ও গণতন্ত্রের প্রয়োজনে জনগণের ঐক্য কখনও ব্যর্থ হয় না- এ অভিমত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের। তার দৃঢ় আশাবাদ, এবারও গণতন্ত্রের স্বার্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে জনগণের যে ঐক্য হয়েছে, তা সফল হবে। ক্ষমতাসীনদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি আরও বলেন, এ ঐক্য কোনো দলের নয়, আপামর জনগণের। ঐক্যফ্রন্টকে সিলেটে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, কোনো দলকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে, কাউকে দেওয়া হবে না- এটা অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য প্রমাণ করে, সরকার নির্বিঘ্নে মাজার জিয়ারতের নিশ্চয়তা দিতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তিনি জানান, সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার কারণ জানতে চেয়ে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। লিখিত জবাব পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে যাবেন। অন্যদিকে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকালের মহাসমাবেশে যে সংশয় প্রকাশ করেছেন, সে বিষয়ে নিজের উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল শনিবার মতিঝিল চেম্বারে সমকালকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন, আন্দোলনের কর্মসূচি, ঐক্যের ভবিষ্যৎসহ সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েই কথা বলেন তিনি। কিছু স্পর্শকাতর প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেও সময় হলে সেসব প্রশ্নেরও উত্তর দেবেন বলে জানান তিনি।
নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন এবং এর সাফল্যের ব্যাপারে প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, এই ঐক্য জনগণের ঐক্য, কোনো দলের নয়। তারা শুধু উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন। ঐক্যের ব্যাপারে সারাদেশ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন। এরই মধ্যে এটি জনগণের ঐক্য হয়ে গেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দাবি হচ্ছে- সবার অংশগ্রহণে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সারাদেশের মানুষও এটা চায়। বিগত নির্বাচনের মতো আবারও ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার মতো একতরফা নির্বাচন তারা চায় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে জনগণের ঐক্য কখনও ব্যর্থ হয় না। এবারের ঐক্যও যে সফল হবে, সে ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী তিনি।
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠনের নামে দেশে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে সরকারপক্ষের অভিযোগের বিষয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, এমন মন্তব্য দুঃখজনক। তারা সবকিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র দেখেন। কথায় কথায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন। গণতন্ত্রকে ইতিবাচক হিসেবে এগিয়ে নিতেই এ ঐক্য গড়ে তোলা হয়েছে। আশা করব, তারা ভেবেচিন্তে কথা বলবেন।
ড. কামাল বলেন, ২০০৭ সালে মামলা করে এক লাখ ৪০ হাজার ভুয়া ভোটার বাতিল করেছেন তিনি। সর্বোপরি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে সরাতে ভূমিকা রেখেছেন। এতে দেশদ্রোহ মামলার আসামিও হয়েছেন তিনি। আগামী নির্বাচন নিয়ে নীলনকশা আছে বলেই সরকার জনগণের এ ঐক্যের সমালোচনা করছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন করতে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে সবার সঙ্গে আলোচনা করে আরেকটি নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ কথার বরখেলাপ করে পাঁচ বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছে। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে শুনানির সময় তিনি অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে সরকারি দলের দেওয়া প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেন। ওই সময় আদালত বলেছিলেন, সরকারি দল সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে। অথচ আদালতের এ ধরনের বক্তব্যের পরও সরকার নির্লজ্জভাবে পাঁচ বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছে।
আদালতের গুরুত্বপূর্ণ এ বক্তব্যের বিষয়টি কেন তিনি এত দিন সামনে আনেননি- তা জানতে চাইলে বিশিষ্ট এ আইনজীবী বলেন, এটা আমার ব্যর্থতা। বিষয়টি নিয়ে পরে আবার আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত ছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অভিযোগ তুলে ন্যাপ ও এনডিপির বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এ অভিযোগ সঠিক নয়। ওয়ান-ইলেভেনের সঙ্গে যুক্ত কেউ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে নেই।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঐক্যফ্রন্টের কয়েকটি সভায় উপস্থিত থাকায় এ অভিযোগ ওঠা স্বাভাবিক কি-না- এ প্রসঙ্গে ড. কামাল বলেন, তিনি আমাদের সঙ্গে ঠিক ওইভাবে নেই। এমনকি ঐক্যফ্রন্টের কোনো পদ-পদবিতেও নেই।
নির্বাচন সামনে রেখে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বড় দলগুলোর টানাটানি ও ভাঙাগড়ার খেলা চলছে? যাকে ‘ছোট দলের বড় কদর’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল বলেন, বিষয়টি আমি ওইভাবে দেখছি না। নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলের মধ্যে টানাটানি হবেই। দেখতে হবে মূল লক্ষ্য কী? এখন দেখা যাচ্ছে, সবাই আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার দাবিতে একমত। গণতন্ত্রের স্বার্থে লক্ষ্য অর্জনে ছোট-বড় সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি আদায় করতে চায়। কাজেই এ দাবিতে আন্দোলনের শরিক হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবেই দেখা উচিত।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি ও ১১ লক্ষ্যকে সংবিধানপরিপন্থী আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করার ঘটনায় সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, কীভাবে সংবিধানপরিপন্থী হলো- বিষয়টি তাদের যুক্তি দিয়ে পরিস্কার করে বলতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এ দাবি ও লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, অতীতেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধন করে একটি কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছিল। এমনকি সংবিধান সংশোধন করে বর্তমান সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছিল।
দাবি পূরণ না হলে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে কি-না- এ প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তারা শেষ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এ মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক কিছু বলতে চান না। নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা বর্জনের বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক বি. চৌধুরী স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ককারীদের নিয়ে জোট না গড়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং নির্বাচনে জোটের দেড়শ’ আসন চেয়েছিলেন। বর্তমানেও ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো প্রায় ১০০ আসন বিএনপির কাছে দাবি করবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে বিকল্পধারাসহ দেড়শ’ আসন চাওয়া ‘অমূলক’ কোথায়? এ সম্পর্কে ঐক্যফ্রন্টের এ শীর্ষ নেতা কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বি. চৌধুরীর পক্ষ থেকে নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে অভিযোগ তোলা হয়েছে- তা খুবই দুঃখজনক। সবাইকে জানিয়েই বৈঠকের স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। একটি ‘অজুহাত’ দেখিয়ে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অভিমান করে আমার বাসার সামনে থেকে চলে যাওয়া উচিত হয়নি। ঐক্যের ব্যাপারে আন্তরিক থাকলে এবং আলোচনায় বসলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত। এখনও তিনি (বি. চৌধুরী) যদি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেন- আমরা খুশি হব। তিনি একজন সম্মানিত মানুষ, আমরা তাকে স্বাগত জানাব।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কার্যত প্রধান নেতা কে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যৌথ নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট পরিচালিত হচ্ছে। আন্দোলনও চলবে যৌথ নেতৃত্বে। জোটের প্রধান নেতার পদটি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য খালি রাখা হচ্ছে কি-না- এমন প্রশ্নে প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ বলেন, জোটের কোনো শীর্ষ নেতা নেই। এমনকি শীর্ষ নেতার পদ কারও জন্য খালিও রাখা হয়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের যৌথ নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে এবং বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া কারামুক্ত না হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন- এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় গণতন্ত্রের পদ্ধতির রীতি অনুযায়ী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল থেকেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে থাকেন। আগামীতে সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন।
সিলেটে জনসভার অনুমতি না দেওয়ার বিষয়ে ড. কামাল বলেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। সে অধিকারবলে শনিবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি মহাসমাবেশ হয়েছে। তার কয়েকদিন আগেও বড় একটি দল সেখানে বিশাল জনসভা করেছে। আর ক্ষমতাসীন দলও সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আর মাত্র ১০-১২ দিনের মধ্যে কারও দাবি-দাওয়া নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করার প্রয়োজন ও সময় নেই বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেন বলেন, তার এ বক্তব্যে প্রমাণ হয় তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তরিক নন। সরকারি দলের একজন দায়িত্বশীল নেতার মুখ থেকে এ ধরনের বক্তব্যে তারা অবাক ও বিস্মিত হয়েছেন। টালমাটাল পরিস্থিতিতেও ‘৭০-এর নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছিলেন, সেগুলো পড়ে নেওয়ার জন্য ওবায়দুল কাদেরের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
নির্বাচন হওয়া নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শঙ্কার বিষয়ে গণফোরাম সভাপতি বলেন, তার বক্তব্যে আমরাও উদ্বিগ্ন। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাসী আমরা।
সূত্রঃ সমকাল