সুনীল বড়ুয়া:
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানোর আঘাতে লন্ডভন্ড কক্সবাজারের উপকূল। ঘরবাড়ি,রাস্তাঘাট,বেড়িবাঁধ,খেত-খামার,লবন মাঠ তো আছেই, সৃষ্ট জলোচ্ছাসে কক্সবাজারের আট উপজেলায় শুধুমাত্র মৎস্য খাতেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি টাকা।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কবলে পড়েছে চিংড়ী খাত। ক্ষতিগ্রস্থ প্রায় ৫৭ হাজার একর চিংড়ী ঘেরে টাকার হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯৫ কোটি টাকা। জেলা মৎস্য বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে ক্ষয়ক্ষতির এ চিত্র পাওয়া গেছে।
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়িরা বলছেন,কক্সবাজারের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ মৎস্য খাত। কিন্তু ঘুর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে এ খাতটি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সরকারি বিশেষ সহযোগিতা না পেলে এ খাতকে পুনরুজ্জিবিত করা কষ্টসাধ্য হবে। অনেক ব্যবসায়ির ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবেনা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে,ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর বাতাসের তীব্রতা কম হলেও,ঘুর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ঠ জলোচ্ছাসে কক্সবাজার, সদর,চকোরিয়া,পেকুয়া,মহেশখালী,টেকনাফ,উখিয়া,রামু ও কুতুবদীয়া আট উপজেলায় ২ হাজার ৩৮০টি পুকুর, ২৩২টি মৎস্য খামার, ৫৬ হাজার ৭১৭ একর চিংড়ী মাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় তিনশ কোটি টাকা।
এছাড়াও দেশের বৃহত্তম শহরের নাজিরারটেক এলাকায় অবস্থিত শুটকী মহালে প্রায় ২৫ লাখ টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রজাতীর প্রায় ৬শ মেট্রিক শুটকী মাছ নষ্ট হয়ে গেছে।
কক্সবাজার সদরে ক্ষতির কবলে পড়েছে তিনটি মাছ ধরার নৌকা ও সাড়ে সাত লাখ টাকার মাছ ধরার জাল। সব মিলিয়ে জেলায় শুধুমাত্র মৎস্যখাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা। এর মধ্যে চিংড়ী প্রকল্পের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে খুব বেশি।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সবিরুর রহমান জানান,ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে জেলার কুতুবদীয়া,মহেশখালী,পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্নস্থানে অন্তত ৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এসব বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বর্ষার পরে বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।
এদিকে পূর্ণিমার জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছাসে আট উপজেলার প্রায় সব পুকুর,মৎস্য প্রকল্প ও চিংড়ী ঘের পানিতে ভেসে গেছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় এসব এলাকাগুলো এখন জোয়ার ভাটায় ভাসছে। যে কারণে নতুন করে মৎস্যচাষ ও শুরু করা যাচ্ছেনা।
বুধবার সরেজমিনে শহরের খুরুস্কুল এলাকার বিভিন্ন মৎস্য খামার পরিদর্শনে গেলে দেখা গেল শুধুই ক্ষতচিহ্ন। সব খামারের বেড়িবাঁধ ভাঙ্গা,বিধ্বস্থ অবস্থা। খুরুস্কুল ব্রীজ পার হয়েই চোখে পড়লো একটি চিংড়ী খামার। এ খামারের মালিক চিংড়ী চাষী মো.ইসলাম জানান, এক সময় তিনি লবন ও চিংড়ী চাষ করতেন। এখন করেন শুধুই লবন। কিন্তু ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতে তাঁর পাঁচ একর চিংড়ী খামারের অন্তত চার লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। এখন তিনি বলতে গেলে নিঃস্ব।
এ খামারের পাশেই গুলতাজ মৎস্য খামারেরও দেখা গেল একই দৃশ্য। সব বাঁধ ভাঙ্গা। এ খামারের কর্মচারী নুরুল হাকিম জানালেন, এ বছর তারা ফেব্রুয়ারী থেকে চিংড়ী চাষ শুরু করেন। জুনে মাছ ধরার কথা। কিন্তু এর আগেই সব চিংড়ী জলোচ্ছাসের পানিতে ভেসে গেছে।
আর একটু সামনে এগুলে জানা গেল এই এলাকার নাম কুলিয়া পাড়া। এখানকার অবস্থা আরো ভয়াবহ। সব চাষীর স্বপ্ন ধুলিষ্যাৎ করে দিয়ে গেছে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়। এখন তাদের শুধু একটাই ভাবনা তারা কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন।
কুলিয়া পাড়া এলাকার চিংড়ী ও লবন চাষী ছিদ্দিক আহম্মদ বললেন,এ বছর ৪০ একর জমিতে তিনি লবন চিংড়ী ও লবন চাষ করেন। লবনের উৎপাদন এবং দাম বেশ ভাল ছিল। কিন্তু মৌসুমের শেষের দিকে এসে মাঠে মজুদ করা প্রায় ১০ হাজার মণ লবন পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। একই এলাকার মো. রিপন জানান,তাদের ৫০ একরের চিংড়ী ঘেরে প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার চিংড়ী উৎপাদন হতো। খরচ বাদ দিয়ে অন্তত তাদের লাভ হতো দশ লাখ টাকা। কিন্তু এবারের লাভের স্বপ্ন জলোচ্ছাসের পানিতে ভেসে গেছে। শুধু এরা নন,এদের মতো শত শত ব্যবসায়ী এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ধুলিষ্যাৎ হয়ে গেছে তাদের সব স্বপ্ন।
কক্সবাজার চিংড়ী ব্যবসায়ী সমিতির নেতা আব্দুল্লাহ খান জানান,আমাদের একটাই দাবি আমরা পুণরায় ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের সহায়তা চাই। সরকারী সহায়তা না পেলে ক্ষতিগ্রস্থ প্রায় চারশো চিংড়ী প্রকল্প আর চালু করা যাবেনা। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও অনেকাংশে কমে আসবে।
মৎস্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান খুলনা,বাগেরহাট,সাতক্ষীরা,কক্সবাজারসহ সারা দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ীর চাষ করা হয়। এতে প্রতিবছর প্রায় ৯০০ কোটি পোনার দরকার পড়ে। আর এসব পোনার চাহিদা মেটাতে কক্সবাজারের কলাতলী,ইনানী ও টেকনাফ সৈকতে স্থাপন করা হয়েছে ৫৭টি প্রজনন হ্যাচারি। কিন্তু ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ চিংড়ী ঘের ও খামারগুলো চালু না হলে হ্যাচারি গুলোতে পোনা উৎপাদনে ধস নামতে পারে।
হ্যাচারি মালিকদের সংগঠন শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, চিংড়ী প্রকল্পগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় বর্তমানে পোনার চাহিদা কমে গেছে। ফলে গত কয়েকদিনে ১০ থেকে ১২টি হ্যাচারির উৎপাদন বন্ধ আছে।
সব মিলিয়ে শুধুমাত্র মৎস্য খাতেই সাড়ে তিনশ টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন জানালেন,কক্সবাজার জেলার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ মৎস্য সম্পদ। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছাসে মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলার প্রায় সব উপজেলার পুকুর,বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে তোলা মৎস্য খামার, ৫৬ হাজার ৭১৭ একর চিংড়ী ঘের সবমিলে অন্তত তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি প্রাথমিকভাবে নিরুপন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এবারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে চিংড়ী খাত। সাড়ে তিনশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে শুধুমাত্র চিংড়ী খাতেই ক্ষতির পরিমাণ ১৯৫ কোটি টাকা।