বিশেষ প্রতিবেদনঃ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি মাত্র এক সপ্তাহ। নির্বাচন কেন্দ্র করে মাঠ পর্যায়ের উত্তাপ এখন ছড়াতে শুরু করেছে প্রশাসনেও। সম্প্রতি সরকার সমর্থক কর্মকর্তা হওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন জেলার কর্মকর্তাদের বদলির ঘটনা ঘটেছে। আবার সরকারবিরোধী কার্যকলাপের কারণে এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
সূত্র জানাচ্ছে, এক দশক ধরে সক্রিয়, কিন্তু সুবিধাবাদী কিছু কর্মকর্তার হঠাৎ নীরব ভূমিকায় নানা প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। পাশাপাশি প্রশাসনে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিকভাবে তৎপর হয়ে উঠেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে তাদের সংগঠিত করছেন সাবেক কয়েকজন আমলা। পুরো প্রক্রিয়া সমন্বয় করছেন দীর্ঘ আট বছর ধরে ওএসডি থাকা বর্তমান সরকারের একজন সচিব ও ওএসডি থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া একজন যুগ্ম সচিব।
এ পরিস্থিতিতে সরকার কঠোর নজরদারিতে রেখেছে প্রশাসনকে। সরকার সমর্থিত কয়েক কর্মকর্তাকে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর পরও বসে নেই কর্মকর্তাদের বিএনপি-জামায়াতপন্থি অংশটি। অভিযোগ, ভেতরে ভেতরে তারা সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই সরকারবিরোধী কার্যকলাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই সরকার এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া যাবে, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, গত এক দশকের শাসনামলে প্রশাসনের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে ওএসডি এবং পদোন্নতিবঞ্চিত রয়েছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ‘বঞ্চনার ক্ষোভ’ থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। ‘বঞ্চিত’দের সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে সংগঠিত করা হচ্ছে। তাদের ঘিরে গোপনে বিএনপির দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রশাসনের কয়েকজন সাবেক আমলা।
সক্রিয় ঘাপটি মারা কর্মকর্তারা :প্রশাসনের ভেতর এতদিন আওয়ামী লীগার সেজে ঘাপটি মেরে থাকা ব্যক্তিরাও এখন সুযোগ বুঝে সরকারবিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছেন। নির্বাচনের তফসিলের আগে থেকেই প্রশাসনে চিহ্নিত বিএনপিপন্থি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তারা। এ কার্যক্রম সমন্বয় করছেন দীর্ঘ আট বছর ধরে ওএসডি থাকা বর্তমান সরকারের সচিব ইবাদত আলী ও ওএসডি থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া যুগ্ম সচিব বিজয়কান্তি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিএনপিকে সরকার ও সরকারি দল এখন এমন পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছে যে, সামনে দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। ফলে এবার কার্যকর প্রতিবাদ না করার কোনো বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সমকালকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে সব কর্মকর্তাকেই সতর্ক করা হয়েছে। ওএসডি ও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারাও চাকরিরত। তারা রাজনৈতিক কোনো কাজে অংশ নিতে পারেন না। এটা সরকারি আচরণবিধির পরিপন্থী। সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ প্রমাণ হলে নিয়োগকারী মন্ত্রণালয় বা নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় সরকারি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, অবসরে যাওয়া কিছু কর্মকর্তা সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। ফলে কয়েকদিন আগে অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নজরদারিতে রেখেছে।
সরকারি দল সমর্থক হিসেবে পরিচিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব সমকালকে বলেন, সচিব বা যুগ্ম সচিব পদ থেকে অবসর নিলেও সাবেক কয়েকজন আমলার এখনও প্রশাসনে প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তারা বিশেষ কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করতে চাইছেন। এমন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার পর তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
এদিকে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিজে সম্পৃক্ত হননি বলে দাবি করেছেন বর্তমান সরকারের সচিব (ওএসডি) মো. ইবাদত আলী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততা নেই। ওএসডি কর্মকর্তাদেরও সংগঠিত করছেন না তিনি। ওএসডি বা পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তার বর্তমানে কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই। ঘরে বসেই অবসর সময় কাটান তিনি। আগামী জানুয়ারি মাসে অবসরে যাবেন বলেও জানান তিনি।
তবে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গ্রন্থাগার কাম সভাকক্ষে অর্ধশতাধিক ওএসডি উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব প্রকাশ্যে সরকারবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নেন। এসব কর্মকর্তা আবারও বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে ভেতরে ভেতরে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। ওই নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন সচিবসহ শীর্ষ পর্যায়ের ৪২ জন সাবেক আমলা সরকারবিরোধী তৎপরতায় অংশ নেন। তখন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ এস এম আবদুল হালিম ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব এস এম জহুরুল ইসলামসহ অবসরপ্রাপ্ত ৩১ কর্মকর্তার সচিবালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। তাদের মধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা এবার বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। এরই মধ্যে এই কর্মকর্তারা বিএনপির পক্ষে একাধিক বৈঠক করেছেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এলে পদোন্নতিসহ নানা সুবিধার কথা বলে অন্য কর্মকর্তাদেরও সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
একত্র করার চেষ্টা ‘বঞ্চিত’দের :প্রশাসনের তিন স্তরে (উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব) বর্তমানে ওএসডি হিসেবে আছেন ৬০৮ কর্মকর্তা। পদোন্নতিবঞ্চিত রয়েছেন আট শতাধিক কর্মকর্তা। তাদের একত্র করার জন্য নানা কৌশল নির্ধারণ করেছে বিএনপি। অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা বঞ্চনার ক্ষোভে সরকারবিরোধী কার্যক্রমে গোপনে অংশ নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় অতিরিক্ত সচিব (ওএসডি) মফিদুল ইসলাম ও যুগ্ম সচিব (ওএসডি) ছিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে। মফিদুল ইসলাম জানান, বর্তমান প্রশাসনে যে যার মতো সুবিধা নিচ্ছে; কিন্তু সরকার তাকে কেন ওএসডি করেছে, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তার সঙ্গে বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভালো সম্পর্ক নেই বলে জানান তিনি। ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ওএসডি করার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে তিনি সরকারবিরোধী কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মাঠ দখলের রাজনীতি যে দলের পক্ষে থাকে, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা সচরাচর সেদিকেই ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে এমন চিত্রই দেখা গেছে। তাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের নামে পর্দার আড়ালে আসলে বাতাস বুঝে খোলস পাল্টানোর প্রস্তুতি চলছে প্রশাসনে।
নির্বাচন সামনে রেখে সরব হওয়ার শঙ্কায় দুই দফায় বিএনপিপন্থি দশজন কর্মচারী নেতাকে সচিবালয় থেকে সরিয়ে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এসব কর্মচারী (ক্যাডারবহির্ভূত) নেতাদের মধ্যে সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে একজন সিনিয়র সহকারী সচিব ও নয়জন সহকারী সচিব হয়েছিলেন। তবে বদলি করার পর এখনও কয়েকজন কাজে যোগ দিতে পারেননি। এই কর্মচারী নেতারা একসময় ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। সচিবালয়ের এও-পিওদের বিএনপিপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত কয়েকজনকেও রদবদল করা হয়েছে। কয়েকজন নেতাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বিএনপিপন্থি কর্মচারী নেতারা। এরপর তাদের কয়েকজন চাকরিচ্যুত হয়েছেন। কয়েকজন সরকারদলীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিশে গেছেন। তবে এখন তাদের অনেকে আবার গোপনে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপিপন্থি এক কর্মচারী নেতা বলেন, সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত কর্মচারী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতা গত পাঁচ বছর নিজেদের আড়ালে রাখলেও ভোটের আগে তারা সরব হওয়ার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন স্থানে গোপন বৈঠক করে সরকারবিরোধী কর্মকর্তাদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এদিকে সচিবালয়ে সরকারপন্থি কর্মকর্তাদের সংগঠিত ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব ও বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত যুগ্ম সচিব মো. খাইরুল ইসলাম সরকারপন্থি কর্মকর্তাদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বেশকিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এস এম আবদুল হালিম সমকালকে বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। সরকারের বর্তমান কর্মকর্তারা বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, কেউ এমন বলে থাকলে তা পুরোপুরি ভুল। প্রশাসনের শীর্ষ কিছু কর্মকর্তা অনেক সময় অতিউৎসাহী হয়ে এসব অভিযোগ করেন। এটা ঠিক নয়। তা ছাড়া কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সার্ভিস রুল অনুযায়ী তদন্ত করে শাস্তি দেওয়া উচিত। তবে প্রশাসনে অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক কারণে অনেক কর্মকর্তাকে নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। এটাও ঠিক নয়। যারা সরকারি চাকরিতে কর্মরত তাদের সরকারের সব নিয়মকানুন মেনে চলা উচিত। সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া যায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, সাবেক আমলারা সরকারবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন না। সরকারের কাছে যদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো স্পষ্ট তথ্য থাকে, তা হলে তথ্যানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে।
সূত্রঃ সমকাল