আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
শ্রীলঙ্কায় এক দশকের মধ্যে ভয়াবহ বোমা হামলার ‘হোতা’ মোহাম্মদ হাশিম মোহাম্মদ জাহরান নিজের কট্টর মতের কারণে বার বার নানা জায়গা থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন।
ভারত মহাসগারের তীরের ছোট্ট শহর শ্রীলঙ্কার কাত্তানকুড়িতে দুই কক্ষের একটি বাড়িতে পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন জাহরানের পিতা-মাতা।
জাহরানের বাবা রাস্তায় রাস্তায় খাবার বিক্রি করতেন। মাঝে মধ্যেই যার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উঠতো।
১২ বছর বয়সে জাহরান ‘জামিয়াতুল ফালাহ অ্যারাবিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ এ লেখাপড়া শুরু করেন।
জাহরানের জন্য তার বাবা তেমন কিছু করতেন না বলে জানান কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল এস. এম. আলিয়ার।
নিজের অসাধারণ স্মরণশক্তি দিয়ে শুরুর দিকে শিক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন ছোট্ট জাহরান। সেখানে তিন বছরে তিনি মুলসমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন মুখস্ত করে হাফেজ হন। তারপর তিনি ইসলামি আইন নিয়ে লেখাপড়া শুরু করেন।
কিন্তু দিন দিন শিক্ষকদের সঙ্গে জাহরানের মতবিরোধ বাড়তে থাকে।
আলিয়ার বলেন, “শিক্ষকরা কোরআনের উদার ব্যাখ্যা করতেন, যেটা জাহরানের পছন্দ ছিল না। সে চরমপন্থি ইসলামের দিকে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে, শিক্ষকদের সঙ্গে তর্ক করা শুরু করে। দিন দিন সে এতটাই অবাধ্য হয়ে উঠছিল যে আমরা তাকে স্কুল থেকে বের করে দেই।”
আলিয়ারের বয়স এখন ৭৩। এখনো তিনি ২০০৫ সালে জাহরানকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা স্পষ্ট মনে করতে পারেন। তিনি বলেন, “তার বাবা আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন ‘সে কোথায় যাবে?’।”
এক সময় একগুঁয়ে জাহরানকে শিক্ষকরা ভুলে গিয়েছিলেন। আবার তারা জাহরানের নাম শুনলেন, যখন পুরো বিশ্ব তার নাম জানে।
গত ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডের পরবে শ্রীলঙ্কার তিনটি গির্জা ও চারটি অভিজাত হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৫৩ জন নিহত হয়, আহত হয় পাঁচ শতাধিক মানুষ।
এক দশক আগে দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে একদিনে এত রক্ত ঝরেনি।
শ্রীলঙ্কা সরকারের ধারণা, ভয়ঙ্কর ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জাহরান। যে নিজেও হামলা অংশ নিয়েছে।
জাহরান শাংরি লা হোটেলে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে বলে জানান দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা।
মোট নয়জন আত্মঘাতী হামলাকারী ওই দিন আট জায়গায় হামলা চালায়। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, হামলাকারীরা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা এবং উচ্চশিক্ষিত। তাদের কেউ কেউ বিদেশেও লেখাপড়া করেছেন; ব্যতিক্রম একমাত্র জাহরান।
‘বখে যাওয়া এক তরুণ’
জাহরান ২০০৫ সালে স্কুল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর নিজের শহর কাত্তানকুড়িতে ফিরে যান।
রাজধানী কলম্বো থেকে সড়ক পথে কাত্তানকুড়ি যেতে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। অসংখ্য তালগাছ, সড়কের পাশে বুদ্ধমূর্তি আর ঝোপের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়ার হাতির শহর কাত্তানকুড়িতে ৪০ হাজার মানুষের বাস।
বিশ্ব মানচিত্রে শ্রীলঙ্কার পূর্ব উপকূলে বিন্দুর মত দেখতে শহরটিতে স্কুল থেকে বহিষ্কার এক সদ্য তরুণের কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না।
২০০৬ সালে জাহরান ‘দারুল আথার’ নামে একটি মসজিদে যোগ দেন এবং সেটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হন।
কিন্তু তিন বছর পর তাকে সেখান থেকেও বের করে দেওয়া হয়।
মসজিদের ইমাম এম.টি.এম. ফাওয়াজ বলেন, “তিনি স্বেচ্ছাচারী ছিলেন, বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শ না নিয়ে তিনি নিজের ইচ্ছামত বয়ান করতে চাইতেন।”
জাহরান কট্টর রক্ষণশীল ছিলেন বলেও জানান তিনি। বলেন, এমনকি নারীদের চুড়ি ও কানের দুল পরা নিয়েও তার ঘোর আপত্তি ছিল।
“আমাদের বাকিরা সমাজের নেতা হিসেবে সকলের জন্য কথা বলতেন। কিন্তু জাহরান শুধু নিজের বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে চাইতো।
“সে একটা কুলঙ্গার ছিল যাকে খোলা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।”
২০০৯ সালে মসজিদ কমিটি জাহরানের বয়ান দেওয়ার উপর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
মসজিদ কমিটির প্রধান মোহাম্মদ ইসমাইল মোহাম্মদ নওশাদ বলেন, “আমরা তাকে বিগড়ে যাওয়া যুবা হিসেবে বিবেচনা করতাম, যে খুব সংকীর্ণ মনের ছিল এবং সবসময় সমস্যার কারণ হত।”
মসজিদ থেকে জাহরানকে বের করে দেওয়ার পর তিনি একদল অনুসারী জোগাড় করেন, যারা একটি কুঁড়েঘরে বৈঠক করতে বলেও জানান ইমাম ফাওয়াজ।
২৩ বছরের জাহরান কলম্বো উপকণ্ঠের একটি ছোট্ট শহরে বিয়ে করেন এবং স্ত্রীকে কাত্তানকুড়িতে নিয়ে আসেন।
তার স্ত্রীর বয়স মাত্র ১৪ ছিল বলে জানান তার বোন মাথানিয়া।
বাগ্মী জাহরান ছোট ছোট শহরে ঘুরে ঘুরে তার কট্টর মতের প্রচার শুরু করেন। ওই অঞ্চলে জনপ্রিয় সুফিবাদের সঙ্গে তার মতের সংঘর্ষ হয় এবং সুফি নেতারা জাহরানের বিরুদ্ধে প্রাশসনে অভিযোগ দেওয়া শুরু করেন।
অনলাইনে চরমপন্থা:
জাহরান নানা র্যালি ও সমাবেশ করতে থাকেন। যেখানে তিনি উচ্চকণ্ঠে বিদ্বেষ উগড়ে দিতে থাকেন।
২০১২ সালে তিনি নিজের একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। সুফিবাদের অনুসারীরা স্থানীয় প্রশাসন এবং সন্ত্রাস দমন কর্মকর্তাদের কাছে তার বিরুদ্ধে জোরাল অভিযোগ করতে থাকে। কিন্তু প্রশাসন তখন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি।
জাহরান তার বক্তৃতায় সুফিবাদীদের ‘কাফির’ (অবিশ্বাসী) বলতে থাকেন।
নিজের মতের প্রচারে ইন্টারনেটকে হাতিয়ার বানান জাহরান। ফেইসবুকে নিজের একাউন্ট খুলে তিনি সেখানে নানা ভিডিও পোস্ট করা শুরু করেন।
বহিষ্কার:
জেদি, একগুঁয়ে এবং কট্টর জাহরানকে বারবার বহিষ্কার হতে হয়েছে। এমনকি নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ থেকেও তাকে বের করে দেওয়া হয়।
জাহরানের স্কুলের বন্ধু তাউফিক বলেন, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জাহরানের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদের দেয়ালে তাকে বহিষ্কারের নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
“প্রথমে স্কুল থেকে, তারপর দারুল আথার মসজিদ থেকে এবং তারপর আমরাই তাকে বের করে দিলাম, তার জন্য এসব মেনে নেওয়া খুব কঠিন ছিল।”
পরের বছর কাত্তানকুড়ি থেকে সড়ক পথে পাঁচ ঘণ্টা দূরের শহর মাওয়ানেল্লায় বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর হওয়ার পর পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। আত্মগোপনে চলে যান জাহরান।
হামলার প্রস্তুতি:
ইস্টার সানডের ঠিক তিনদিন আগে বৃহস্পতিবার জাহরানের ভাইয়ের স্ত্রী প্রতিবেশী এক নারী দর্জির কাছে যান এবং কাপড় দিয়ে ওই দিনের মধ্যে একটি কুর্তা বানিয়ে দিতে বলেন।
নারীদর্জি সিথি নাজলিয়া বলেন, “তিনি বলেছিলেন, তিনি পরিবারের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাবেন।”
জাহরানের বোন জানান, শুক্রবার সারাদিন বাবা-মার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় তিনি শনিবার তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখেন তারা কোথাও চলে গেছে।
“নিরাপত্তার জন্য জাহরানই বাবা-মাকে কোথাও সরিয়ে নিয়েছে কিনা বা কেন তিনি হামলা চাললেন তার কিছুই আমি জানি না।”
সূত্রঃ বিডিনিউজ