সাকিব জামালঃ
‘প্রজাপতি প্রজাপতি/ কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গীন পাখা/ টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা।’ খুবই পরিচিত লাগছে! বন্ধুরা, জানোতো এটি কার লেখা! এটি লিখেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের মধ্যে শিশুসুলভ সারল্য ছিল। শুধু তা-ই নয়, তার মনটা ছিল শিশুর প্রতি ভালোবাসায় ভরপুর। তিনি দেখতেন শিশুর মধ্যে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন আর মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন শিশুর জীবন অসীম সম্ভাবনাময়। তারা চেষ্টা করলেই পারবে তাদের সম্ভাবনাময় জীবন কাজে লাগাতে। এ কথাটিতে তিনি আস্থা রেখেই লিখেছেন-
‘তুমি নও শিশু দুর্বল, তুমি মহৎ ও মহীয়ান
জাগো দুর্বার, বিপুল বিরাট অমৃতের সন্তান।’
এই যে শিশুদের প্রতি যে কবির এত আস্থা, তার নিজের ছেলেবেলাটা কেমন ছিল, জানো? ছেলেবেলায় তিনি ছিলেন খুবই দুষ্টু, ডানপিটে। ভরদুপুরে খোলা মাঠে ছোটাছুটি, রোদ্দুরে ডাংগুলি খেলা, দুষ্টু মনোভাবে পাখির বাসায় ঢিল ছোড়া, গাছ বেয়ে পাখির ছানা চুরি করে খেলা, এর গাছের আম, ওর গাছের লিচু সাবাড় করা তার নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। বড় হয়েও তিনি তার ছেলেবেলার দুরন্তপনাকে ভোলেননি, ধরে রেখেছেন মনে।
কাজী নজরুল ইসলাম কেবল একজন বিদ্রোহী চেতনার মানুষই ছিলেন না, তার মধ্যে লুক্কায়িত ছিল অপরিমেয় রঙ্গ-তামাশা বোধ। কবির জীবনের কিছু ঠাট্টাময় ঘটনা:
১. শিল্পী আব্বাস উদ্দিন একদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে নজরুলকে না পেয়ে সকালে তার বাসায় গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখলেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছেন। নজরুল ইশারায় আব্বাস উদ্দিনকে বসতে বললেন। আব্বাস উদ্দিন অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি উসখুস করতে লাগলেন। নজরুল বললেন ‘কি তাড়া আছে, যেতে হবে?’ আব্বাস উদ্দিন বললেন, ‘ঠিক তাড়া নেই, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেওয়ার জন্য।’
নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিষ্কার চাদর তার ঘরের আলমারি থেকে বের করে বিছিয়ে দিলেন। জোহরের নামাজ শেষ করার সাথে সাথে নজরুল আব্বাস উদ্দিনের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার গজল।’ আব্বাস উদ্দিন বিস্ময়ের সাথে দেখলেন তার নামাজ পড়তে যে সময় লেগেছে ঠিক সেই সময়ের মধ্যে নজরুল সম্পূর্ণ একটি নতুন গজল লিখে ফেলেছেন। সেটিই হলো বিখ্যাত সেই গজল, ‘হে নামাজি আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/ দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ…’।
২. একবার নজরুল গেছেন সিরাজগঞ্জে, আসাদ উদ্দৌলা সিরাজীর বাসায়। খাওয়াদাওয়ার পর সবাইকে দই দেওয়া হলো। কিন্তু সে দই আবার টকে গিয়েছিল। হয়তো দই একটু আগে ভাগেই নিয়ে আসাতে এরকম হয়েছিল, নষ্ট হয়ে টক হয়ে গেছে। আর তা খেয়ে নজরুল কী বললেন জানো? আসাদ উদ্দৌলার দিকে তাকিয়ে চোখে-মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, ‘তুমি কি এই দই তেঁতুল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি?’ আর তা শুনে সবাই তো হেসেই খুন!
৩. ছোটদের জন্য পাঠ্যবই লিখতেন আলী আকবর সাহেব। একদিন নজরুল ইসলামকে একটি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে মতামত চাইলেন। পুরো পাণ্ডুলিপিটি পড়ে নজরুল বললেন, আপনার পাণ্ডুলিপির ছড়াগুলো ছোটদের উপযোগী হয়নি। যদি বলেন তো আমি একটা ছড়া লিখে দিতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুরোধ করলেন নজরুলকে একটি ছড়া লিখে দেওয়ার জন্য। নজরুল ইসলামও দু’খিলি পান মুখে পুরে লিখলেন সেই বিখ্যাত ‘লিচু চোর’ ‘বাবুদের তালপুকুরে/ হাবুদের ডালকুকুরে/ সেকি ব্যস করল তাড়া/ বলি, থাম-একটু দাঁড়া…’
৪. পুতুলের মতো ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে অঞ্জলি। একদিন নজরুল বারান্দায় বসে আছেন। হঠাত্ তার চোখ পড়লো অঞ্জলির ওপর। নজরুল দেখলেন, একটা পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ-ঠোঁট উল্টিয়ে, হাত-পা নেড়ে অঞ্জলি যেনো কার সঙ্গে কথা বলছে। সেই কথা আর শেষই হতে চায় না। নজরুল ভাবলেন, নিশ্চয়ই কেউ পেয়ারা গাছে উঠেছে। তার কাছে কাকুতি-মিনতি করে অঞ্জলি পেয়ারা চাইছে, কিন্তু গাছের ওপর যে, সে পেয়ারা দিচ্ছে না।
নজরুল তো ছোটদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি ভাবলেন, অঞ্জলির হয়ে পেয়ারা চাইবেন। ছেলেটা দেয় তো ভালো। না দিলে নিজেই পেয়ারা পেড়ে দেবেন। মজার ব্যাপার হলো, অঞ্জলির সামনে গিয়ে কবি নজরুল গাছের ওপর কাউকেই দেখতে পেলেন না। তবে অঞ্জলি কথা বলছিলো কার সঙ্গে?
নজরুল তখন অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার সাথে কথা বলছিলে? অঞ্জলি বললো, কাকাবাবু! ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালী। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না। কাঠবেড়ালীর সঙ্গে অঞ্জলির এই মান অভিমানের ঘটনাটি নজরুলকে এতোটাই চমত্কৃত করলো যে, এ ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য লিখলেন ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ নামের সেই কবিতা। ‘কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?/ গুড়-মুড়ি খাও! দুধ-ভাত খাও? বাতাবি লেবু? লাউ?…’
৫. কবির এক বন্ধু ছিল, শৈলেন নাম। কবি তার কাছ থেকে কেবল চা খেতেন। আর প্রতিদিন শৈলেনের কাছ থেকে চা খাওয়ার জন্য নিত্যনতুন ফন্দি আঁটতেন। একদিন আর কোনো ফন্দি-ফিকির না পেয়ে কী করলেন; শৈলেনের কাছে গিয়ে বললেন, ‘তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে, হিসেব করে রেখো, আপাতত দু পেয়ালা চা দাও।’ শৈলেন তো অবাক! এ আবার কেমন কথা! অনেক টাকা পাওয়ার সঙ্গে দু পেয়ালা, মানে দুই কাপ চায়ের কী সম্পর্ক? তিনি চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দু পেয়ালা কেন?’
কবি বললেন, ‘আরে, লাখ পেয়ালা চা না খেলে টাকা হয় না। লাখ পেয়ালা হতে আমার এখনো দু পেয়ালা বাকি আছে।’ এমন কথার পর কোনো বন্ধু চা না খাইয়ে থাকতে পারে, বলো!
শিশু-কিশোরদের প্রিয় হৃদয়পটে চিরভাস্মর কবি কাজী নজরুল। আন্দোলন, প্রেম, রাজনীতি, কি নেই তার গান-কবিতায়। হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি কাজী নজরুলের মতো এতো সহজ সরল করে কেইবা লিখতে পেরেছেন? তাইতো তিনি বিদ্রোহী কবি।
সূত্রঃ বিডিনিউজ