অনলাইন ডেস্কঃ
ছেলে জঙ্গি হামলায় নিহত হওয়ার পর ভেঙে গিয়েছিল মন, সেই শোক সইতে না পেরে স্ত্রীও গত হয়েছিলেন বছরখানেক আগে; অভিজিৎ রায় হত্যার বিচার শেষ হওয়ার আগেই চিরবিদায় নিলেন তার বাবা অধ্যাপক অজয় রায়।
সোমবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে হাসপাতালের পরিচালক শহীদুল হক মল্লিক জানান।
শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায়ের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ফুসফুসের সংক্রমণের পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় তিনি ভুগছিলেন।
জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ২৫ নভেম্বর থেকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অধ্যাপক অজয় রায়। ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট বাড়লে দুইদিন পর থেকে তাকে কৃত্রিম শ্বাস দেওয়া হচ্ছিল।
শিক্ষায় অবদানের জন্য একুশে পদক পাওয়া অজয় রায় ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। স্ত্রী শেফালী রায়ের মত তিনিও তার দেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য দান করে গেছেন বলে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জানান।
অজয় রায়ের ছোট ছেলে অনুজিৎ রায় জানান, রাতে তার বাবা কফিন রাখা হবে বারডেমের হিমঘরে। মঙ্গলবার সকালে শেষবারের মত তাকে নেওয়া হবে বেইলি রোডের বাসায়।
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেলা ১১টা থেকে এক ঘণ্টা অজয় রায়ের কফিন রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, তার মরদেহ বারডেম কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান অনুজিৎ।
১৯৩৬ সালে দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করা অজয় রায়ের শিক্ষকতার শুরু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ১৯৫৯ সালে তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে। ২০০০ সালে অবসরের পরও ইউজিসি অধ্যাপক ছিলেন তিনি।
ষাটের দশকের শেষে ইউনেসকোর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত ক্রিস্টালোগ্রাফি সেন্টার স্থাপনে অজয় রায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পদার্থবিদ্যায় তার দুটি গবেষণা নোবেল কমিটিতেও আলোচিত হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অজয় রায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন। কুমিল্লার সোনামুড়া সীমান্তে প্রশিক্ষণ শেষে একাধিক অপারেশনে যোগ দেন তিনি। পরে মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সাম্মানিক সদস্য হিসবে দায়িত্ব পালন করেন।
একাত্তরের মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন এবং শিক্ষকদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে ভূমিকা রাখেন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন অজয় রায়। এছাড়া সম্প্রীতি মঞ্চের সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার আন্দোলনে অধ্যাপক অজয় রায় যতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসারের কাজেও তিনি ছিলেন সামনের কাতারে।
বাংলা ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন মুক্তান্বেষার প্রধান সম্পাদক অজয় রায়ের উদ্যোগেই নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় মুক্তমনা ব্লগ প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি ছিলেন ওই ওয়েবসাইটের অন্যতম উপদেষ্টা। পরে তার বড় ছেলে অভিজিৎ রায় মুক্তমনার দায়িত্ব নেন।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলা থেকে বেরিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন প্রবাসী লেখক অভিজিৎ রায়। সেদিন উগ্রবাদীদের হামলার শিকার হয়ে হাতের আঙুল হারান অভিজিতের স্ত্রী ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যাও।
অজয় রায়ের অসুস্থতার খবর ফেইসবুকে শেয়ার করে সম্প্রতি বন্যা লিখেছিলেন, “কী পূর্ণ এবং স্বার্থক একটা জীবনই না কাটিয়েছেন বাবা। কিন্তু তার পরক্ষণেই মনে হলো গত পাঁচ বছরে যে কষ্ট পেয়েছেন, সেটাও তো বলার মতো না।
”সেই ২০১৫ থেকেই উনি যে ভেঙে পড়তে শুরু করেছেন, সেটা আর ঠিক হয়নি। এই বছরের শুরুতে অভির মা মারা যাওয়ার পর সেই ভেঙে পড়াটা শুধু তরান্বিতই হয়েছে।”
চার বছর আগে ছেলে নিহত হলে অজয় রায়কেই মামলা করতে হয়েছিল। সেই মামলায় গত ২৮ অক্টোবর আদালতে গিয়ে তিনি সাক্ষ্যও দিয়েছিলেন।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বারডেম হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, “অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার বিচারের বিলম্বের কারণে রায় দেখে যেতে পারেননি তার বাবা অজয় রায়। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।”
সূত্রঃ বিডিনিউজ