চিররঞ্জন সরকারঃ
কাজ অনেকেই করেন, করেছেন। কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিক উদ্যোগটি নিয়ে সাফল্যের শীর্ষে কজন পৌঁছতে পারেন? স্যার ফজলে হাসান আবেদ পেরেছিলেন। সব রকম বাধা-বিপত্তিকে তুচ্ছ করে তিনি এগিয়ে গেছেন নিজের স্বপ্নপূরণের গন্তব্য। সেই স্বপ্নটাও বেশ খাপছাড়া। শক্তিহীনকে শক্তি যোগানো। যাদের দাবি-দাওয়া-কণ্ঠস্বর কারো কাছে পৌঁছয় না, তাদের কন্ঠকে উচ্চকিত করা। তাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভূমিকা রাখা। তিনি এ জন্য প্রচলিত পথে পা বাড়াননি। তিনি জানেন চেনা সংগঠন অভ্যস্ত বুলি হারিয়ে যায়। তাই তিনি নতুন সংগঠন গড়েছেন। নতুন স্লোগান রচনা করেছেন। ছোট ছোট উদ্যোগ। ছোট ছোট সাফল্য। সেই সাফল্যের পথ ধরে আবারও নতুন উদ্যোগ। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ দিয়ে বিরাট এক জাগরণ। তা শুধু দেশের গণ্ডি নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন। কোটি কোটি পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে রেখেছেন অপরিমেয় অবদান। সদা হাসিখুশি শ্যামলা গড়নের এই ছোটখাট মানুষটি তার কীর্তি দিয়ে নিজেকে বিশাল এক মহীরূহে পরিণত করেছেন। নিজেকে নিয়ে গেছেন বিশাল এক উচ্চতায়।
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে এমন একটা শিক্ষিত, সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফজলে হাসান আবেদ। মা সাইয়েদা সুফিয়া খাতুন ও বাবা সিদ্দিক হাসান। তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন ফজলে হাসান আবেদ পাবনা জেলা স্কুল ও ঢাকা কলেজ থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে মাত্র ১৮ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমন করেন। ১৯৫৪ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে জনপ্রিয় বিষয় ছেড়ে নেভেল আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়ে সবাইকে অবাক করেছিলেন। খবর শুনে চোখ যেন চড়কগাছ— এটা আবার কোন বিষয়? শেষ পর্যন্ত তিনি চার্টার অ্যাকাউন্টিং লেখাপড়া করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিশ্ববিখ্যাত বহুজাতিক শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগদান করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার পুরস্কারস্বরূপ তিনি কোম্পানির হেড অব ফিন্যান্সের পদও জয় করে নিলেন। তার সামনে তখন বহুজাতিক কোম্পানির বড় কর্মকর্তা হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।
সত্তরের ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাস ও মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের বর্বরতা ফজলে হাসান আবেদের জীবনকে এমনভাবে নাড়া দিল যে তিনি বহুজাতিক কোম্পানির আরাম-আয়েশের জীবন বর্জন করে মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ এটাকেই ধ্রুব হিসেবে মেনে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি আর চাকরির দিকে ফিরে তাকাননি। তিনি তার লন্ডনের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে সাহায্য ও অবহেলিত নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকার জন্য তহবিল গড়ার কাজে মনোযোগী হলেন। ফ্ল্যাট বিক্রির অর্থ দিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করা হলো। বাংলাদেশের অন্যতম অবহেলিত ও দুর্গম শাল্লা অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ত্রাণ ও পুনর্বাসন দিয়ে কাজ শুরু হয়।
নিজ এলাকা শাল্লায় কয়েকশ দরিদ্র পরিবারের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন। কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, দারিদ্র্য শুধু আয় ও কর্মসংস্থানের ব্যাপার নয়— শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সুযোগও বড় জিনিস। আর ত্রাণ কখনো রক্ষাকবচ হতে পারে না। দরিদ্রের টেকসই উন্নতির জন্য আয়বর্ধন জরুরি।
শাল্লার সেই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তিনি নতুন উদ্যোগ চালু করেন। ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় ব্র্যাকের কোনো না কোনো উদ্যোগ-সেবার সম্প্রসারণ ঘটান। এ প্রসঙ্গে কয়েকটা মাইলফলক তো উল্লেখ করাই যায়। সত্তরের দশকের শেষ দিকে এসে এক চিমটি লবণ, আধা লিটার পানি ও একমুঠো গুড় স্লোগান নিয়ে সাড়া জাগানো ওরাল স্যালাইন বিপ্লব; আশির দশকে শিশুর টিকা নিয়ে বিস্তৃত অঞ্চলে কাজ; নব্বই ও পরবর্তী দশকে কৃষি, খাদ্য ও বীজ বিপ্লব; যা বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। এমনকি বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার এনে দিয়েছে। অবহেলিত শিশুদের শিক্ষা, অনেকটা রূপকথার মতো গ্রামীণ স্বাস্থ্যে সম্পৃক্ততা; ২০০০ ও পরবর্তী সময়ে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ঘিরে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এছাড়া দরিদ্রের জাত বা ভৌগোলিক কোনো সীমানা নেই, এই আপ্ত বাক্য মনে রেখে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দারিদ্র্য নিরসনে কাজ করার জন্য ‘ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল’ প্রতিষ্ঠা করে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম শুরু হয়। মোটকথা, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টি, ক্ষুদ্র অর্থায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন হেন ক্ষেত্র নেই, যেখানে স্যার আবেদের চিন্তা-চেতনার রশ্মি পৌঁছেনি। তবে তার চিন্তা-চেতনা ছিল বহতা নদীর মতো, কখনো এক জায়গায় থেমে ছিল না। তিনি চিন্তার ওপর পরীক্ষা করেছেন বলে রূপান্তরের নায়ক হয়ে উঠেছেন।
স্যার আবেদ জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন সমাজের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবন-মান উন্নয়ন ঘটানোর। তিনি হচ্ছেন বঞ্চিতদের বাতিঘর। দরিদ্রের দিশারি। গরিবসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সময়ে নামিদামি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের এ নীরব বিপ্লবের মহানায়ক। ২০১৫ সালে তাকে বিশ্বখাদ্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কারদাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, স্যার আবেদ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য অপনোদনে নবধারামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
আর স্যার আবেদ এই পুরস্কার দরিদ্রকে উৎসর্গ করে বললেন, ‘প্রকৃত নায়ক হচ্ছে দরিদ্র নিজেই বিশেষ করে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত দরিদ্র নারী সমাজ, যারা প্রতিদিন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। সারা বিশ্বে আমাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে গিয়ে দেখেছি দেশ ও সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও বাস্তবতা, সংগ্রাম, আশা ও দারিদ্র্যের স্বপ্ন প্রায় এক।’
২০০৪ সালে ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন পুরস্কার দেয়ার সময় প্রতিষ্ঠানের প্রধান যা বলেছিলেন সেটা হচ্ছে, ‘প্রথমে আমরা পুরস্কারটি দিয়েছিলাম ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টকে, যিনি তার দেশে অনেক মানব উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। দ্বিতীয়বার যখন পুরস্কারের জন্য বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের তথ্য ঘাঁটছিলাম, আমরা লক্ষ করলাম তাদের তুলনায় ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদ অনেক বেশি কাজ করেছেন। সুতরাং সিদ্ধান্ত নিলাম পুরস্কারটি দেশের প্রেসিডেন্টকে না দিয়ে মানুষের প্রেসিডেন্টকে দেব’।
সংকীর্ণতা, বিতর্ক ও দলাদলির এই দেশে স্যার ফজলে হাসান আবেদ নিজেকে আশ্চর্যজনক ভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি কখনও কোনো দল বা মতের পক্ষে কথা বলেননি। কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গেই নিজেকে কখনও জড়িয়ে ফেলেননি। তিনি তার বিশ্বাস ও উদ্যোগগুলোকে কাজে পরিণত করার ব্যাপারে অধিক মনোযোগী ছিলেন। রাজনীতি না করেও তিনি তা করেছেন। তবু তার অনেক উদ্যোগের সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব ও কাজ সব ধরনের বিতর্ককে তুচ্ছ বানিয়ে ফেলেছে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ সম্পর্কে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছিলেন, ‘একটা জাতির সেরা মানুষেরা জন্মায় সেই জাতির মানুষদের গড়পড়তা স্বভাবের বিরুদ্ধতা করে। লক্ষ করে দেখেছি, অনেক ব্যাপারেই তার স্বভাব গড়পড়তা বাঙালির উল্টো। কথার ফুলঝুরিসর্বস্ব বাঙালি হয়েও তিনি মিতবাক। কথা ব্যাপারটিকে তিনি সব সময় ছাড়িয়ে যান কাজ দিয়ে। তার সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী গোলাম মোর্তোজা লিখেছেন, ‘প্রশ্ন না করলে তার কাছ থেকে উত্তর মেলে না।’ আত্মপ্রচার এ যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু তিনি আত্মপ্রচারহীন। সব বাঙালির মতো তিনিও কবিতা ভালোবাসেন কিন্তু কবিতার উচ্ছল ফেনিলতা তার স্বভাববিরুদ্ধ। তার মধ্যে আগ্রহ প্রবল কিন্তু সে আগ্রহ নিঃশব্দ। আত্মসর্বস্ব বাঙালির মধ্যে তিনি পুরোপুরি পরসর্বস্বতায় প্রোথিত। তিনি প্রতিভাবান মানুষ কিন্তু তার চেহারা প্রতিভাবানদের মতো জ্বলজ্বলে নয়। বিপুল কর্মযজ্ঞের নেতৃত্বে থেকেও তিনি নিম্নকণ্ঠ। প্রতিভা তার মধ্যে আছে, কিন্তু তা একেবারেই মৃদু ও নিরীহ অবয়বে। বার্নার্ডশ লিখেছেন, কমন সেন্স ইজ দ্য মোস্ট আনকমন থিং। তার মধ্যে এই কমন সেন্স রয়েছে খুবই উঁচু মাপে। সহজে যুদ্ধের মাঠের বিখ্যাত সেনাপতিদের মতো তিনি উপস্থিত সমস্যার অনায়াস সমাধান দিতে পারেন।’
কোনো রকম বাগাড়ম্বর ছাড়া শুধু কাজ দিয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদ অসাধারণ কীর্তি গড়েছেন। তার কীর্তি সব বিতর্ককে ছাপিয়ে গেছে সহজেই। তিনি গরিব মানুষের ভাগ্যন্নোয়নে অসামান্য ভূমিকা পালন করেননি, প্রিয় স্বদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তিও তুলে ধরেছেন বিশ্বের দরবারে। তার গড়া প্রতিষ্ঠানটিকে যোগ্য নেতৃত্বের হাতে তুলে দিয়ে তবেই তিনি বিদায় নিয়েছেন।
বন্ধুবর হাসান মামুনের ভাষায় বলতে হয়, খুব কম মানুষের মৃত্যুতেই ‘অপূরণীয় শূন্যতা’র সৃষ্টি হয়- যদিও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই আওড়াই এ আপ্তবাক্য। আবেদ সাহেবের বেলায় সত্যি সত্যিই এ কথা বলা যাবে এবং এ জায়গাটায় জন্মাবে এক অনির্বচনীয় বেদনা। ক্ষুদ্র, চতুর ও বাচাল মানুষের দেশে এর ভার বহনের যোগ্য যেন হয়ে উঠি!
চিররঞ্জন সরকার কলামিস্ট।
সূত্রঃ বিডিনিউজ