তন্ময় ইমরানঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি ‘হ্যাকশো রিজ’ (Hacksaw Ridge) সিনেমাটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ডেসমন্ড ডস নামের মার্কিন বাহিনীর এক যোদ্ধার জীবনী নিয়ে তৈরি।
ডেসমন্ড ডস সেই যোদ্ধা যিনি ভয়াবহ সম্মুখ সমরেও নিরস্ত্র হয়ে অন্যরকম এক যুদ্ধ করেছেন। ডসের যুক্তি ছিল- তিনি একজন চিকিৎসক। যে হাত জীবন বাঁচায়, সে হাত অস্ত্র ধরতে পারে না।
যুদ্ধের ডামাডোলের ভেতরে ‘হ্যাকশো রিজ’ নামের খাড়া পাহাড় থেকে নিরস্ত্র চিকিৎসক ডেসমন্ড ডস একক চেষ্টায় বাঁচিয়েছিলেন পঁচাত্তর সেনার জীবন।
ডস এর লড়াইটা ছিল দু-তিনদিনের। আর ফজলে হাসান আবেদের লড়াইয়ের বয়স অর্ধশতাব্দী।
সামাজিক যাবতীয় নাগপাশ, কালো থাবাকে সরিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে, তার সীমারেখা দেখিয়েছেন ফজলে হাসান আবেদ। ছোট ছোট পদক্ষেপে এক অন্যরকম লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেটি এমন এক অহিংস মুক্তির লড়াই, যা সারাবিশ্বের ‘রোল মডেল’ হয়ে থাকবে আরও সুদীর্ঘকাল।
পার্থিব বিচারে ৮৩ বছর মানুষের জীবনের জন্য খুব কম সময় নয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তো দীর্ঘই বলা চলে। কিন্তু স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো মানুষ যখন ৮৩ বছর বয়সে মারা যান, তখন মনে হয় ‘বড় ক্ষণজন্মা’ ছিলেন।
সত্তর সালের নভেম্বরের প্রলঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় আবেদের জীবন পাল্টে দিয়েছিল। বন্ধু ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, সহকর্মী কায়সার জামান, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আকবর কবীর এবং নটরডেম কলেজের শিক্ষক ফাদার টিম মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন ত্রাণ বিতরণ করতে তারা মনপুরায় যান। এসময় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে মনপুরা দ্বীপের বিপন্ন ও বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্যার ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানির বড়কর্তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইসলামাবাদ ও কাবুল হয়ে লন্ডনে চলে যান। লন্ডনে গিয়ে সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সম্পৃক্ত হন স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটো সংগঠন।
‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ -এর কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমর্থন আদায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত তৈরি এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত কার্যকলাপ বন্ধে ইউরোপীয় দেশসমূহের সরকারকে সক্রিয় করে তোলা।
‘হেলপ বাংলাদেশ’ -এর কাজ ছিল অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি, প্রচারপত্র বিলি, টাইমস অব লন্ডনে লেখা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা, রেডিও ও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া, ইউরোপীয় দেশসমূহের পার্লামেন্ট সদস্যদের আলোচনার মাধ্যমে স্বদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিবিধ কর্মতৎপরতা পরিচালনা করা। পথনাটক, তহবিল সংগ্রহসহ নানা ধরনের কাজেও তিনি ও তার বন্ধুরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন।
কিন্তু মূল লড়াইটা তিনি চালিয়ে গেছেন। সেটা শুরু স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ এ। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী শরণার্থীদের নিয়ে। লন্ডনের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে চলে আসেন বাংলাদেশে। গড়ে তোলেন ব্র্যাক।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যা শত চেষ্টাতেও পারেনি, ফজলে হাসান আবেদ তার প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক দিয়ে সেটাই করে দেখালেন। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার খোলসে নীরব এক নারীমুক্তির আন্দোলন গড়ে উঠলো। মৌলবাদীদের নাকের ডগার উপর দিয়ে, তাদেরকে অসহায় করে ব্র্যাক গ্রামীণ নারীদের মূলধারার অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করলো।
আমরা যদি ফজলে হাসান আবেদের কাজের ধারা দেখি তাহলে দেখবো তার রণকৌশল আসলেই অনন্য ছিল। প্রথম প্রথম পুনর্বাসনের কাজ করলেও পরে তিনি শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর কাজ করলেন। সবশেষে আবেদ হাত দিলেন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকে। এখানেও তিনি অনন্য। তড়িঘড়ি করে চটজলদি কোনও রাস্তায় ছোটেননি। বরং গোড়া থেকে শুরু করেছেন।
গ্রামের স্কুলে মেয়েরা দলেবলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে স্কুলে যাচ্ছে- বাংলাদেশে এই অপরূপ দৃশ্যপটের জন্মদাতা ফজলে হাসান আবেদ। সামাজিক মনস্তত্ব ভেঙ্গে নারীকে বাইরে নিয়ে আসার এ পথে হাঁটতে হাঁটতেই আজকে আমাদের নারীরা গার্মেন্টস শিল্পে এবং অন্যান্য শিল্পে অনন্য ভূমিকা রাখছেন।
এ বছরের অগাস্টেই ব্র্যাক থেকে অবসর নিয়েছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। সক্রিয় দায়িত্ব থেকে অবসর নিলেও তার দেখানো পথে পরিবর্তনের প্রয়োজনেই ব্র্যাক তার নতুন পথরেখা সাজাবে বলে জানিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের আসিফ সালেহ বলেছিলেন, “ব্র্যাক সব সময় সময়ের আগে ছিল।”
একদম সঠিক কথাটিই তিনি বলেছিলেন। কেননা, ব্র্যাকের স্বপ্নদ্রষ্টা আবেদ আর দশটা ডোনার এজেন্সি নির্ভর কোনও সাম্রাজ্যবাদী প্রেসক্রিপশনে চলা এনজিও কাঠামো গড়ে তোলেননি। বরং আড়ংয়ের মতো এর অনেকগুলো ‘এন্টারপ্রাইজ’ এর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন স্বনির্ভর হওয়ার অর্থনৈতিক লড়াই।
২০২১ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর অনেক দাতাগোষ্ঠী ফান্ড দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। ব্র্যাক ‘তহবিল সংকট’ মোকাবেলায় আগে থেকেই বিকল্প ভেবে রেখেছে বলে জানিয়েছিলেন আসিফ সালেহ।
ফজলে হাসান আবেদের প্রয়াণ খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসার পর দুইটি তথ্যে নজর আটকে গিয়েছিল।
প্রথম তথ্য, ২০০০ সালের দিকে অ্যাপল প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস এর সাথে দেখা হয়েছিল আবেদের। সেই সাক্ষাতে বিশ্বের অন্যতম জিনিয়াস স্বীকৃত জবস নাকি আবেদকে বলেছিলেন- তোমার মডেলটা এতো চমৎকার আন্তর্জাতিকভাবে কেন কাজ করো না? সেই থেকে আবেদ প্রথম ভাবলেন দেশের বাইরে কাজ করা দরকার।
দ্বিতীয় তথ্য, ২০০২ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থার তৎকালীন প্রধান আফগানিস্তানে ভয়াবহ যুদ্ধের ভেতর কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোতে কাজ করতে পৃথিবীর সব দেশের প্রতিনিধিদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তখন ঘর ভর্তি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কেউ সাড়া দেননি। কেবল ফজলে হাসান আবেদ হাত তুলে বলেছিলেন, ‘আমি যেতে পারি’।
এই দুইটি তথ্যে কেন চোখ আটকে গেল?
প্রথমটিতে স্পষ্টতই প্রমাণ হয়, আবেদের দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক হলেও তিনি ছিলেন বরাবরই বাংলাদেশ অন্তপ্রাণ। নতুবা কাজ শুরুর ৩০ বছর পর স্টিভ জবস-এর পরামর্শে কেন তিনি ব্র্যাককে দেশের বাইরে নিয়ে যাবেন! আরও আগেই তো পারতেন।
দ্বিতীয় তথ্যটির সাথে আবেদের শুরুটা মিলে যায়। তিনি একাত্তরের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শুরু করেছিলেন নতুন এক যুদ্ধ। যে যুদ্ধে তিনি সফল হয়েছিলেন। সেই ফজলে হাসান আবেদ আফগানিস্তানে মানবতার সেবায় লড়াইয়ে সামিল হবেন না, তো কে হবে?
আবেদের হাত সেবার হাত, পরিবর্তন ও জীবন দানের হাত। অহিংস এই মুক্তিসেনার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
সূত্রঃ বিডিনিউজ