সমকালঃ
দেশজুড়ে নারী-শিশুর ওপর নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার ৫১ দশমিক ৬২ ভাগই ধর্ষণের দখলে। ধর্ষণ মামলার পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি মাসে ৫৯৯টি এ ঘটনা ঘটে। মামলার হিসাবে মাসে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটছে ৪১টি। তবে ধর্ষণের সঠিক সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী মানসম্মানের ভয়ে মামলা করেন না। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাধর অভিযুক্ত চাপ সৃষ্টি করে ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেয়।
নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের সাজার হারও অনেক কম। পরিসংখ্যান বিশ্নেষণে দেখা গেছে, মাত্র ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ ঘটনায় সাজা পেয়েছে অপরাধীরা। আর ধর্ষণ মামলার তদন্তে ১৩টি জায়গায় অনেক সময় ভুল করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পরিসংখ্যান মতে, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে এক হাজার ৭৯৯টি। একই সময় গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১২৫টি। ধর্ষণের ঘটনায় ছেলেশিশুর সংখ্যা ছিল ৩৮, কন্যাশিশু ৫৫৮ ও প্রাপ্তবয়স্ক নারী এক হাজার ৩১৮ জন। মামলায় এজাহারনামীয় অভিযুক্তের মধ্যে ছেলেশিশু ৮৫ জন। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দুই হাজার ৯৯৮ জন।
পুলিশের তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনায় ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছেলেশিশু, মেয়েশিশু ২৯ দশমিক ১৫ শতাংশ ও প্রাপ্তবয়স্ক নারী ৬৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
দেশে যে কারণে শিশু ও নারীর ওপর সহিংসতা হয় তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ধর্ষণ। এ ছাড়া অপহরণ ২২ দশমিক ৪৯ শতাংশ ও যৌতুকের জন্য ২৫ দশমিক ৫১ শতাংশ। নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতার মোট মামলার ৮২ শতাংশ থানায় রুজু করা হয়। অভিযোগপত্র দেওয়া হয় ৮৭ ভাগ মামলার। ১৩ ভাগ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। আদালতে মামলা করা হয় ১৭ শতাংশ ঘটনার।
মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী সমকালকে বলেন, ‘সমাজে এখনও নারীর সুরক্ষা বলয়ের বিষয়ে অনেক ঘাটতি রয়েছে। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা হয় না। এ ছাড়া নারীর প্রতি সহিংস ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক বিচারের নজির কম। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত সব জায়গায় দ্রুত বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃষ্ণপদ রায় সমকালকে বলেন, ‘নারীর প্রতি যে কোনো সহিংসতার অভিযোগ পেলেই সেটার তদন্তে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, নির্যাতন ও ধর্ষণ-সংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। থানায় থাকতে হবে নারী ও ভিকটিমবান্ধব পরিবেশ। কমিউনিটি পুলিশের মাধ্যমে অপরাধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে পদক্ষেপ নিতে হবে জনসচেতনতা বাড়ানোর। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভেজাইনাল সোয়াব ও পরনের কাপড় তাৎক্ষণিকভাবে জব্দ করে পাঠাতে হবে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে। বিচারকালে সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ধর্ষণ মামলার তদন্তে পুলিশ যেসব ভুল করে সেগুলোর মধ্যে ১৩টি উল্লেখযোগ্য। যেমন- ধর্ষণ ও গণধর্ষণ মামলায় শুধু ভিকটিমের আলামত সংগ্রহ করা হয়। সঠিকভাবে সংগ্রহ করা হয় না অভিযুক্তের আলামত। ভিকটিমের পরনের কাপড় ও অন্যান্য আলামত সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয় না। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মামলায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না নারী তদন্ত কর্মকর্তাকে। তদন্তকারী অনেকেই মামলায় একাধিক অভিযুক্তের ডিএনএ সংগ্রহ করতে জানেন না। মামলায় ভিকটিমকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, যা সঠিক নয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা হয়। আবার ভিকটিমকে তাৎক্ষণিকভাবে মেডিকেলে না পাঠিয়ে মামলার জন্য চাপ দেওয়া হয়। ছেলেশিশু ধর্ষণের তদন্তে গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। একাধিক তদারককারী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয় একই রকম। মামলায় অভিযোগপত্র দাখিলের পর বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে পুলিশের খোঁজ রাখেন না।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অনেক সময় দেখা যায়, যারা রাস্তায় নারীকে টার্গেট করছে তাদের অনেকে নেশাগ্রস্ত। বিশেষ পরিবহনে যেসব নারী ইভটিজিং বা অন্যান্য যৌন সহিংসতার শিকার হয়, তাতে জড়িতদের অধিকাংশ বিকৃত মানসিকতার।
২০১৮ সালে সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ-সংক্রান্ত ১৭ হাজার ২৮৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ভিকটিমের সংখ্যা ১৭ হাজার ৩৮৯ জন। যাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৮৬১ জন নারী ও তিন হাজার ৫২৮ জন শিশু। এ সময় তিন হাজার ৪৩০টি ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৮০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ, ৫৭৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাসহ ৬৭৩ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। সর্বশেষ শুক্রবার ধামরাইয়ে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে সোহেল নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ভাটারায় দুই শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। ২০১৯ সালের ৬ মে রাতে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার বাহেরচর গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন ঢাকার কল্যাণপুরের ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্টাফ নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়া। পরে মেয়েটিকে একা পেয়ে বাসচালক নুরুজ্জামান, হেলপার লালনসহ তিনজন চলন্ত বাসে বাজিতপুর উপজেলার বিলপাড় গজারিয়া এলাকায় ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে তাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে তারা। নিহত তানিয়া কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে। একই দিনে রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ায় মা-মেয়েসহ একই পরিবারের তিন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক ভ পীরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত বছরের ৫ জুলাই রাজধানীর ওয়ারীতে সাত বছরের শিশু সায়মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে অভিযুক্ত হারুনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জবানবন্দিতে হারুন জানায়, ছাদ দেখানোর কথা বলে সে শিশুটিকে ছাদে নিয়ে যায়। এরপর ধর্ষণের চেষ্টা করে। সায়মা চিৎকার দিয়ে উঠলে সে শিশুটির মুখ চেপে ধরে ধর্ষণ করে। পরে একটি ফাঁকা ফ্ল্যাটে তার লাশ রেখে পালিয়ে যায় হারুন।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে মাদারীপুরে মাদ্রাসাছাত্রী দীপ্তি আক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যার পর মুখ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। নিখোঁজের দু’দিন পর শহরের পাকদী এলাকার একটি পুকুরে পাওয়া যায় তার বিবস্ত্র মৃতদেহ। পরে ১৪ জুলাই সকালে নিহতের স্বজনরা মাদারীপুর সদর হাসপাতাল মর্গে তার লাশ শনাক্ত করেন।
একই মাসে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার ১২ ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ আল আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১২ জুলাই সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ভুক্তভোগীদের একাধিক মামলায় তার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের অক্সফোর্ড হাইস্কুলের ২০ জনের বেশি ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে জুলাই মাসে গ্রেপ্তার হয় সহকারী শিক্ষক আরিফুল ইসলাম আশরাফ। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সে জানায়, পরীক্ষায় ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে বা নম্বর বেশি দেওয়ার কথা বলে সে ছাত্রীদের ধর্ষণ করত। ধর্ষণের ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তা অব্যাহত রেখেছিল সে।
এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ছোঁয়া পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের চালক-হেলপার মিলে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। পরে তার লাশ ফেলে দেওয়া হয় টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুরের পঁচিশমাইল এলাকায়।