মুন্সীগঞ্জের নাটেশ্বরে আবিষ্কৃত হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধনগরী দর্শনে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় জমাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি যেন তীর্থস্থান হয়ে উঠছে। খননকাজ শেষ হলে নাটেশ্বরের এই বৌদ্ধনগরী বাংলাদেশের পর্যটনকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করবে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এই প্রাচীন স্থাপনাটি বিক্রমপুরের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মাটির নিচ থেকে আবিষ্কৃত এই বৌদ্ধনগরীর সম্পদ পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের জন্য যথাযথ সংরক্ষণ এবং খননকাজ অব্যাহত রাখার জোর দাবি মুন্সীগঞ্জবাসীর। প্রাচীন এই সভ্যতাকে ঘিরে এই অঞ্চলকে পর্যটন জোনে রূপান্তর সম্ভব বলে জানা যায়।
বৌদ্ধধর্মের দ্বিতীয় শীর্ষ ধর্মীয় নেতা জ্ঞান তাপস অতীশ দীপঙ্করের স্মৃতিধন্য বজ্রযোগিনীর পার্শ্ববর্তী এই নাটেশ্বর বৌদ্ধদের তীর্থভূমিতে পরিণত হবে বলে আশা করছেন এলাকাবাসী। আর নান্দনিক এই অনন্য-অসাধারণ স্থাপনাগুলো পর্যটকদের জন্য হবে আকর্ষণীয়। বিশেষজ্ঞরা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এখানে ‘আর্কিওলজি পার্ক’ স্থাপনে। সেখানে জাদুঘর ছাড়াও গবেষণার স্থান ও সেমিনারের জন্য হলরুমসহ পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থাসহ নানা রকম সুবিধা থাকবে।
এই খননকাজে প্রশিক্ষত ২শ’ বাংলাদেশী খননকর্মী ছাড়াও চীনা প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা অংশ নিচ্ছেন। এই খননে আধুনিক নানা রকম প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হচ্ছে। অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থানে অতীশ দীপঙ্করের সমসাময়িক বৌদ্ধবিহার, বৌদ্ধমন্দির, অনন্য বৌদ্ধস্তূপ, বিশেষ ধরনের রাস্তা ও অন্য আবিষ্কারসমূহ বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। বিক্রমপুরের নাটেশ্বর বিশ্ব বৌদ্ধ তীর্থকেন্দ্র এবং পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে। এই আবিষ্কার বৌদ্ধদের ইতিহাস সমৃদ্ধশালী ছাড়াও বিশ্ব ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করবে। আবিষ্কৃত হলগুলো যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি আকর্ষণীয়। একটি হলঘরে আবার চারটি বিশাল স্তূপ। আর হলঘরটি ৩ দশমিক ৫ মিটার চওড়া ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এমন একটি নয়, চারদিকে চারটি ‘স্তূপ হলঘর’। সব মিলিয়ে ১৬টি স্তূপ। চাওড়া ইটের প্রাচীর থাকলেও প্রতিটির সঙ্গেই কানেকশন রয়েছে। স্তূপগুলোর নির্মাণশৈলী নান্দনিক। একেবারেই বতিক্রম। যা দেখলে অতিসহজেই স্থপতি সুদক্ষতার প্রমাণ মেলে। সদ্য আবিষ্কৃত স্থাপত্যটি বাংলাদেশে এই প্রথম, যা স্থাপত্য জগতে ইউনিক। আর এই স্থাপনাগুলো প্রায় এক হাজার বছর আগের তৈরি। এগুলো ছিল মাটিচাপা।
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বর দেউলে এবারের খননে বেরিয়ে এসেছে নতুন এই সভ্যতা। চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে এই খননকাজ করছে এখানে। গত বছর এরই পূর্ব পাশে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় ১৩শ’ বছর আগের বৌদ্ধনগরী, যেখানে বৌদ্ধস্তূপ ছাড়াও প্রাচীন রাস্তা এবং ড্রেনসহ নানা স্থাপনা বেরিয়ে আসে। সবকিছু মিলিয়ে নাটেশ্বর বিশ্ব ঐতিহ্যে অংশ হতে চলেছে বলে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন এই খননকাজের গবেষণা পরিচালক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফী মুস্তাফিজুর রহমান ও চীনের হুনান প্রাদেশিক প্রত্নতাত্ত্বিক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. চাই হুয়ানব।
ড. সুফী মুস্তাফিজুর রহমান জানান, আমেরিকার ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় প্রামণিত হয়েছে নাটেশ্বরে আবিষ্কৃত প্রত্নস্থান ১১শ’ বছরেরও অধিক পুরনো। ওই স্থান হতে প্রাপ্ত কাঠ-কয়লায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এখানকার এই প্রত্নস্থানে দুটি পর্যায়ের মানব বসতি ছিল। প্রথম পর্যায় ৭৮০-৯৫০ খ্রিস্টাব্দ এবং দ্বিতীয় পর্যায় ৯৫০-১২২৩ খ্রিস্টাব্দে।
২০১০ সাল থেকে বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খননকাজ শুরু হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের নেতৃত্বে বিক্রমপুর অঞ্চলে ৯টি প্রত্নস্থানে খনন করে প্রাচীন মানব বসতির চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়। ইতোমধ্যে রঘুরামপুরে বিক্রমপুরী বৌদ্ধবিহারে সাতটি বৌদ্ধ ভিক্ষুকক্ষ আবিষ্কৃত হয়েছে। রঘুরামপুরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলমান রয়েছে।
২০১২ সাল থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বর প্রত্নস্থানে উৎখনন কাজ শুরু হয়। প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবিতে কাজের বিশালতার কারণে যুক্ত করা হয় চীনের হুনান প্রাদেশিক প্রত্নতাত্ত্বিক ইনস্টিটিউটকে। ২০১৪ সাল থেকে চীনা এই ইনস্টিটিউটের প্রত্নতাত্ত্বিক দল উৎখনন কাজে যোগ দেয়। ২০১৫ সাল থেকে সাত প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে অংশ নিচ্ছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর চিত্র সঠিকভাবে ধারণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যাধুনিক ক্যামেরাযুক্ত ড্রোন।
যাওয়ার সহজ রাস্তা হচ্ছে ঢাকা মুন্সিগঞ্জ রোডে দিয়ে মুন্সিগঞ্জ মাওয়া রোডের হাতিমারা সোনাররং এলাকার নাটেশ্বর গ্রাম।