গৌতম রায়:
পৃথিবী এখন অস্থির সময় পার করছে। এর ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। অনেকে একে ‘সভ্যতার সংকট’ বলেও অভিহিত করছেন। এক চাপা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সবাই। একদিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটছে, অপরদিকে বাড়ছে তীব্র ধনবৈষম্য। একদিকে রাষ্ট্রগুলো সামরিক খাতে বাজেট বাড়াচ্ছে বছর বছর, অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতার চরম প্রকাশ দেখা দিচ্ছে ব্যক্তির মধ্যে।
চলতি শতকের শুরুতে ইরাকে হামলার মধ্য দিয়ে আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের এক নতুন সূচনা ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক আক্রমণ পুরো বিশ্বকে ভিন্ন অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়। মেরুকরণ হতে থাকে রাজনীতির। যে রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও।
নিজেদের সভ্য বলে দাবি করা মানুষ এই একুশ শতকেও কীভাবে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগতভাবে হত্যালীলা চালায়– সেটি অনুধাবন করা এবং শিক্ষা ও সমাজের দায়দায়িত্বের প্রসঙ্গটি সামনে আনা খুবই জরুরি। শিক্ষার অনেকগুলো কাজের একটি হচ্ছে ব্যক্তির মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো। এ শিক্ষা আনুষ্ঠানিক যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে অনানুষ্ঠানিকও। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আয়োজনের দায়িত্বে থাকে রাষ্ট্র, অনানুষ্ঠানিকের দায়িত্বে থাকে সমাজ, যার মধ্যে পরিবার অন্তর্ভুক্ত।
গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে যেসব ঘটনা বা ঘটনার বহিরাবরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে শিক্ষা ও সমাজ উভয়ই আলাদা আলাদাভাবে মানুষের মূল্যবোধ বিকাশে পরিপূর্ণভাবে সাফল্যলাভ করতে পারেনি। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো খুন-হত্যা-জঙ্গি হামলার ঘটনা, কিংবা ফ্রান্সের নিস শহরে মানুষের ওপর ট্রাক তুলে দেওয়া বা জার্মানির মিউনিখ শহরে হামলা– ঘটনাগুলো পরস্পরসূত্রে গাঁথা থাকুক বা না থাকুক, এগুলো মনুষ্যত্বের অবমাননার প্রমাণ দেয়।
রাষ্ট্র-পরিচালনাকারীরা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছেন, আরও অনেকে হয়তো তেমনটি মনে করতে পারেন। কয়েকটি ঘটনার জন্য পুরো শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন কেউ; কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, শিক্ষা ও সমাজ উভয়ই কাজ করে ব্যক্তি-মানুষ ও তাদের আলাদা আলাদা সত্তাকে নিয়ে। যেখানে আঘাতকারী ও আঘাতের শিকার উভয়েই মানুষ, সেখানে কোনো ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন বলে ফেলে রাখার সুযোগ নেই, উচিত নয়; তাতে ক্ষতি বাড়ে।
এ-ও মনে রাখা দরকার, বিকাশ ও উন্নয়নের গতি তুলনামূলক ধীর। অপরদিকে, ক্ষতির ঝুঁকি বেশি ও মাত্রা ছড়ায় দ্রুত। বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ বাস করে, সেখানে ০.০১ শতাংশও যদি বিপথে যায়, তাহলে এর সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১৬ হাজার মানুষে। ভাবা যায়! অনেক রাজনৈতিক দলেই এত কর্মীসমর্থক নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও এত শিক্ষার্থী নেই। এই ১৬ হাজার মানুষ পরস্পর কানেক্টেড থাকলে তাদের দ্বারা– ভালো ও খারাপ– অনেককিছুই ঘটানো সম্ভব, যা কল্পনারও বাইরে।
সুতরাং সংখ্যা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, শিক্ষা ও সমাজের দায় রয়েছে প্রতিটি ব্যক্তির ওপর। আর এখানেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়ে। গত কয়েক বছর ধরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও গুলশানে হামলা নতুনভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। যারা এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা যদি কোনো আদর্শের কারণে এগুলো করে থাকে, তাহলে বলতে হবে– রাষ্ট্র তার নিজস্ব শিক্ষার আদর্শ অনুযায়ী সবাইকে গড়ে তুলতে পারছে না।
শিক্ষার রাষ্ট্রীয় আদর্শ আছে; আগেও ছিল। থাকতে হয়। রাষ্ট্র সেখানে কতটুকু সফল হচ্ছে, তা বিচার্য বিষয়। শিক্ষার কাজ তো শুধু সার্টিফিকেটধারী মানুষ তৈরি করা নয়, নয় বছর বছর পরীক্ষার্থী তৈরি করার কারখানা গড়া। লাখ লাখ তথ্য শিখে কী হবে যদি সেগুলো হিংসামূলক ও ঘৃণামূলক প্রবৃত্তিগুলোকে দূর না করতে পারে? এ জায়গাটিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু সফল?
এ ধরনের প্রশ্ন যুগে যুগে উত্থাপিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও উঠবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে সে-সময়কার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষার নানা বিষয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। বিশেষত আনন্দ ও বোধহীন শিক্ষা নিয়ে তাঁর প্রচুর সমালোচনা রয়েছে। ইংরেজরা এ দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিল, তার সুফল ও কুফল দুই-ই আছে; কিন্তু ইংরেজরা বিতাড়িত হওয়ার দীর্ঘদিন পরও আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে, আমাদের মতো করে সাজাতে পারিনি। ফলে সুফলগুলো নয়, কুফলগুলো বরং জেঁকে বসেছে। স্বাধীনতার পর ক্রমাগত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও পরিস্থিতি খারাপ করেছে। কিছু পরিবর্তন করতে হয় চটজলদি। স্বাধীনতার পর তৎকালীন রাষ্ট্রীয় আদর্শকে ধারণ করে শিক্ষাব্যবস্থাটিকে তখনই সাজানো গেলে আজকে আমাদের অবস্থান এই পর্যায়ে আসতো বলে মনে হয় না।
ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে যে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই, সেই কমিশন প্রতিবেদনের অনেককিছু তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে আজকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আরও উন্নততর পর্যায়ে থাকতো। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এর পরবর্তী কমিশন বা কমিটিগুলোর প্রতিবেদন গুণে ও মানে খুদা কমিশন প্রতিবেদনের কাছাকাছি যেতে পারেনি; বরং সেগুলোর কিছু কিছু নির্লজ্জভাবে ইংরেজ ও পাকিস্তানি মনোবৃত্তি ধারণ করেছে। যদিও সেসব কমিশনগুলোর কোনো প্রতিবেদনই রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতি আকারে গৃহীত হয়নি, কিন্তু নির্বাহী আদেশে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সেগুলো যে পরোক্ষ অবদান রেখেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
বর্তমানে আমরা যে শিক্ষানীতি অনুসারে চলছি, সেটি যদিও খুদা কমিশনের প্রতিবেদনকে অনুসরণ করেছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতিকে ধারণ করবে– এমন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুনভাবে শিক্ষানীতি তৈরিতে হাত দেওয়া ও সে অনুসারে বাস্তবায়নের দিকে যাওয়া উচিৎ। রাষ্ট্র যে শিক্ষা দেবে, সেই শিক্ষার ফল ও দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। এখানে রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বাজার-অর্থনীতির কাঁধে চড়ে স্রোতে ভাসবে নাকি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে নিজস্ব সত্তা তৈরি করে সে অনুযায়ী রাষ্ট্রের শিক্ষা-কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।
মূল্যবোধ বিকাশে শিক্ষার দায় ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত বিবেচনা করতে হয়। কারণ, শিক্ষার প্রভাব সবচেয়ে বড় ও গভীর। মনে রাখা দরকার, কেউ হুট করে মানসিকতা পরিবর্তন করে একদিনে ঘাতক হয়ে যায় না। এ জন্য দরকার দীর্ঘদিনের চর্চা। শিক্ষার গুরুত্ব এ জায়গাটিতেই। আপাতদৃষ্টিতে যেসব বিষয়কে ধীর ও গতিহীন মনে হয়, কিংবা যেগুলোতে অগুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সেগুলোই আসলে ভিত তৈরি করে দিতে পারে বা দেয়। যে শিশু ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে বেড়ে ওঠে, প্রতিযোগিতা যেখানে মুখ্য; মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সেখানে আস্তে আস্তে গৌণ হয়ে উঠতে শুরু করে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু বাজার-নির্ভর ডিগ্রি প্রদান করে; বাংলা, দর্শন, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় যেখানে উপেক্ষিত, সেখানে মূল্যবোধের বিকাশ বৃদ্ধি কঠিনই বটে।
মানুষের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ যেসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সেগুলোর কতটা শিশুকাল থেকে চর্চা করা হচ্ছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা হলে সেখান থেকে ‘কর্মী উৎপাদন’ হবে ঠিকই, কিন্তু অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলো সুপ্ত থেকে যাবে চিরকাল। মানব-মস্তিষ্ক খালি থাকে না, জমি ফাঁকা থাকলে সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির আগমন বা ‘আইডিয়া’ চাষাবাদ শুরু করবেই। এটাই নিয়ম। আর সেই উদাহরণ কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না?
এ সমস্যা থেকে উত্তরণের সংক্ষিপ্ত পথ নেই। ফলে সমাধানের পথও অনির্দিষ্ট। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে— আজকের শিক্ষাব্যবস্থা, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয়ই যে ত্রুটিপূর্ণ, তা আমরা জোরালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছি না। বরং যখন যে সমস্যা আসছে, সেখানে আবছাভাবে তাৎক্ষণিক সমাধানের প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা ভালোভাবে চলছে না, আমাদের দৈনন্দিন জীবনব্যবস্থা শিশুদের বিকাশের জন্য সহায়ক নয়, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে পরিবার ও সমাজের কোনো ধরনের যোগসূত্র না থাকায় তা হয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্ন– ইত্যাদি বিষয় স্বীকার করে নিলেই কেবল অত্যন্ত ধীর কিন্তু গভীর ও প্রভাবপূর্ণ এক সমাধানের দিকে আমরা পদক্ষেপ শুরু করতে পারব। নয়তো যে সঙ্কট ও হাহাকার চারদিকে, তা বাড়তেই থাকবে।
—————————-
বিডিনিউজ থেকে নেয়া