সমগ্র পূর্ব বাংলায় একুশের ভাষা আন্দোলন এতটা ব্যাপক হয়ে উঠেছিল যে দক্ষিণে দূর সাগরপারের টেকনাফ-কক্সবাজারেও আন্দোলনের ঢেউ লাগে। রাজনীতিমনস্ক ছাত্রদের চিন্তা ছুঁয়ে যেতে পারে একুশে-পরবর্তী কালের বহুখ্যাত রাজনৈতিক স্লোগান ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া…’। কক্সবাজার মহকুমার দূর প্রান্তিক থানা টেকনাফ একুশের উত্তাল ঢেউয়ে শরিক হয়েছিল। ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক-এর মাধ্যমে টেকনাফে পৌঁছায় সূচনার চার দিন পর অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি।
এ খবর জানিয়ে সংবাদ প্রতিবেদক আবদুল কুদ্দুস লিখেছেন যে দেরিতে হলেও এ সংবাদ টেকনাফে পৌঁছার পর টেকনাফ মাইনর স্কুলের শিক্ষক ও বালক ছাত্ররা আন্দোলনে নেমে পড়ে। সাগরের ঢেউয়ে ওঠা কলরবের মতোই শিশু ও বয়স্ক কণ্ঠের উচ্চারণ একাকার হয়ে ওঠে বিক্ষোভের উন্মাদনায়: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
পূর্বোক্ত প্রতিবেদকের ভাষ্যমতে, ২৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু অবিনাশচন্দ্র, বাবু মংনি, সৈয়দুর রহমান পোস্টমাস্টার, মাস্টার আবদুর রবের উৎসাহ ও সহযোগিতায় ছাত্ররা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা, নিম্নমাধ্যমিক শিশুছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন! শুধু তা-ই নয়, ওই বয়সে কোনো ভয়ডর না করে তাদের ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়াও নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।
বায়ান্ন সালের ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি পূর্বোক্ত নিম্নমাধ্যমিক স্কুলের ছাত্ররা স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। মিছিলটি স্থানীয় বাজার ও স্টেশন রাস্তা অতিক্রম করলে সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ শিশুছাত্রদের উৎসাহ দিতে মিছিলে যোগ দেয়।
যেমন যোগ দিয়েছিলেন ‘নূর আহমদ, অলী আহমদ সওদাগর, আবদুর রহমান, আবদুল গণি, সালেহ মাস্টার, যদুনাথ, এম এ শুক্কুর, জালালউদ্দিন আহমদ, বাবু সুব্রত, জহির আহম্মদ, মোহাম্মদ মিয়া মেকার, হোছেন আহমদ, নুরুজ্জামান, নুরুল হক মাস্টার, আবদুল মুনাফ, আমীর হামজা, বদিউর রহমান প্রমুখ। বলা বাহুল্য, এরা সবাই তখনকার টেকনাফ এম ই স্কুলের ছাত্র।’
তখনকার যাতায়াতব্যবস্থার বিবেচনায় টেকনাফ, উখিয়া দুর্গম এলাকা হিসেবেই বিবেচিত হতো। যাতায়াতের একমাত্র ভরসা জলপথ ও জলযান। সাম্পান ছাড়াও যাতায়াত করত দুটো স্টিমার। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন রবি ও বৃহস্পতিবার টেকনাফ থেকে সাগরপথে মহকুমা শহর কক্সবাজার হয়ে জেলা শহর চট্টগ্রাম পর্যন্ত যাতায়াত করত। সরাসরি টেকনাফ-কক্সবাজার কোনো সড়ক যোগাযোগ ছিল না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে যাতায়াত ও যোগাযোগের এমন এক দুরবস্থায় খবর আসা-যাওয়াও ছিল একই রকম। তা ছাড়া, চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রভাব ও স্পর্শ কক্সবাজারে পৌঁছালেও তা টেকনাফ বা উখিয়ার জন্য ছিল দুরস্ত। তাই সংবাদপত্রের দেখা পাওয়া যেত সপ্তাহ খানেকের বাসি খবর নিয়ে।
স্বভাবতই সরকারি দল মুসলিম লীগই ছিল টেকনাফ, উখিয়ার মতো এলাকায় একমাত্র রাজনৈতিক দল। তাদের শাসন-শোষণ দুই-ই চলেছে অব্যাহতভাবে। এমন এক একাধিপত্যের রাজত্বে একুশের প্রতিবাদী মিছিল ও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বলিষ্ঠ উচ্চারণ সবার জন্যই ছিল অবাক হওয়ার মতো ঘটনা।
আন্দোলন নস্যাৎ করতে সরকারি দল মুসলিম লীগ উঠেপড়ে লাগে। তারা টেকনাফে চারটি জনসভা করে ঘোষণা দেয় যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। উর্দুর বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করবে, তারা পাকিস্তানের দুশমন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
প্রতিবেদকের বিবরণমতে, ভাষাবিরোধী পূর্বোক্ত সভাগুলোতে যোগদানকারী নেতা ও ঘোষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধান ব্যক্তি ফজলুল কাদের চৌধুরী (ফকা চৌধুরী), চকরিয়ার মকসুদ আহমদ চৌধুরী, আনোয়ারার নুরুল আনোয়ার, উখিয়ার মীর কাশেম চৌধুরী, রামুর জাফর আলম চৌধুরী, আবদুল গফুর চৌধুরী প্রমুখ রাজনৈতিক বাঘ-সিংহ। বলতে হয়, রীতিমতো রাজসিক আয়োজন ছোট্ট টেকনাফের ততোধিক ছোট ছাত্রদের ভাষিক প্রতিবাদ দমন করতে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে টেকনাফের অবস্থানগত ও রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির বিবেচনায় শিশুছাত্রদের এ আন্দোলন ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তবে তুলনামূলক বিচারে উন্নত অবস্থানের রামু ও কক্সবাজারের ভাষা আন্দোলন ছিল অনেকটা ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ।
(প্রথম আলো থেকে নেয়া)