সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল বলে মনে করেন মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে না থাকায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা।
কিন্তু থেমে থাকেনি ষড়যন্ত্র। আশির দশকের শুরুতে দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে দফায় দফায় বিভিন্নস্থানে হামলা চালানো হয়েছিল। এরমধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এ হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আহত হয়েছিলেন প্রায় চারশ’ মানুষ। সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়েছেন অনেকেই।খবর বাংলাট্রিবিউনের।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বেঁচে থাকা দুই সদস্য শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরাধিকার হিসেবে প্রথমে শেখ হাসিনাকেই হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের একটি অংশ বিএনপি-জামায়াতের কতিপয় নেতা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। এ মামলার অন্যতম আসামি জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানের জবানিতেও এ ষড়যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ উঠে আসে। চারদলীয় জোট সরকারের ওইসব নেতা ও বঙ্গবন্ধুর এক খুনি মেজর নূর ছিলেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনে বসেই এই হামলার ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়েছিল বলেই তদন্তে উঠে এসেছে।
২১ আগস্ট হামলার পরিকল্পনা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান নিজেও। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে তারেক রহমান ছাড়াও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভূমি উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর নূর চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। মুফতি হান্নান ছাড়াও হুজি নেতা মাওলানা তাজ উদ্দিন, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবদুস সালাম ও আবদুল মাজেদ বাট বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।খবর বাংলাট্রিবিউনের।
মুফতি হান্নান তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি ও ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন অভিযোগ করে এর বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, জানতে চাইলে জামায়াত নেতা মুজাহিদ বলেন, আপনার কথা সত্য। শুধু তাই নয়, ইসলামের বিরুদ্ধেও কাজ করছে। ব্যাপকভাবে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। না হয় তাকে এ দেশ থেকে চিরবিদায় কিংবা শেষ করে দিতে হবে। মুজাহিদের বক্তব্য সমর্থন করে তখন বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরী শেখ হাসিনাকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষেই মত দেন। কিভাবে শেষ করতে হবে, সেই পরামর্শও দেন তিনি। তখন লুৎফুজ্জামান বাবর গ্রেনেড ও অস্ত্র সরবরাহ করা যাবে বলে জানান।’
১৪ আগস্টের হাওয়া ভবনের বৈঠকের পর লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুর বাসায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাস্তবায়নের বৈঠক হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১ আগস্ট দুপুরে তারা রামপুরার বাসায় মিলিত হন। সেখানেই গ্রেনেডগুলো হামলাকারীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। মুফতি হান্নান তার ১৫ জন জঙ্গি ক্যাডার নিয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আশেপাশে অবস্থান নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তারা চলে যান।
আদালতে দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্রে এ মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ উল্লেখ করেন, ‘আওয়ামী লীগ, প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোরবিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ও সমমনা সাম্প্রদায়িক কিছু রাজনৈতিক দল পরিকল্পিতভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে।’
আবদুল কাহার আকন্দ আরও উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বহু মাদ্রাসা ছাত্র ও কিছু আলেম আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানের পক্ষে সেভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। তিনি বলেন, ‘এরা সবাই সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মুফতি আবদুল হান্নান, মাওলানা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির, মাওলানা শেখ ফরিদ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা আবু বকর, মাওলানা তাজ উদ্দিন, হাফেজ আবু তাহের ও হাফেজ জাহাঙ্গীর বদর অন্যতম। তারা নিজেদের এখনও আফগান মুজাহিদ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে।’
আফগানিস্তান থেকে তারা দেশে ফিরে হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলে তালেবান স্টাইলে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করে। কাশ্মিরি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন, তেহরিক-ই-জিহাদ আল ইসলামি (টিজেই) ও লস্কর-ই-তৈয়্যেবার স্টাইলে জঙ্গি তৎপরতা চালাতে থাকে। সেই জঙ্গি তৎপরতার ধারাবাহিক কাজেরই একটি অংশ ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতোই ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের হামলার ছক তৈরি করা হয়েছিল। ওই সময়ের কিছু সামরিক কর্মকর্তা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, বঙ্গবন্ধুর খুনি ও জঙ্গি নেতাদের সমন্বয়ে হাওয়া ভবনে বসেই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবকিছু চূড়ান্ত করেন। আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কারা জড়িত সেটা বেরিয়ে আসে। ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এ হামলার যোগসূত্র রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার একটি অনুষ্ঠানে বলেন, এ হত্যার বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে আছে। আমার বিশ্বাস যে আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই মামলায় রায় হবে।’ ওই মামলায় পলাতক আসামিদের খুঁজে বের করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে শুধু বলব, আমরা তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’