হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী:
কক্সবাজারের রামুতে জীবন নিয়ে চলছে বাণিজ্য। শিশু থেকে বৃদ্ধ অপহরণের শিকার হচ্ছেন সবাই। অপহরণকারীদের চাহিদা অনুযায়ী মুক্তিপণের টাকা না দিলেই লাশ হতে হচ্ছে নিরপরাধ মানুষকে। অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েও কাজ হচ্ছে না। তাতে অপহরণকারীরা ধরা পড়ার ভয়ে নির্মমভাবে হত্যা করছে অপহৃতকে।
একারণে অপহরণের ঘটনা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জানাতেও ভয় পান ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। অনেকটা নীরবেই টাকা-পয়সা দিয়ে রফা করা হচ্ছে অপহরণকারীদের সঙ্গে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ঈদগাঁও-ঈদগড়-বাইশারী সড়কে দিন দুপুরে দস্যুদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন এ রকম ঘটনা অসংখ্য। গত সাত বছরে এ সড়কে এক পুলিশ সদস্যসহ তিনজন ডাকাতের গুলিতে নিহত হন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ২০জন। এ জন্য সড়কে চলাচল করতে গিয়ে দিনের বেলায়ও মানুষ ডাকাতের ভয়ে তটস্থ থাকেন।
২২ কিলোমিটার এ সড়কের অন্তত ১৫টি স্থানে নিয়মিত ডাকাতি হয়। এখন শুধু সড়কে নয়, এলাকার বসত ঘরেও ডাকাতি এবং অপহরণের ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কা জনকহারে। কারা এসব অপরাধ করছে, এদের অনেকেই এলাকাবাসীর কাছে চিহ্নিত হলেও ভয়ে মুখ খুলতে পারেননা কেউ। এসব ডাকাতদের কাছে অসহায় এলাকার নিরীহ মানুষ।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় ঈদগড় ইউনিয়নের ধুমচাকাটা সড়কে চলন্ত মিনিবাস ‘হিল লাইন’ থামিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি নুরুল কবির রাশেদ, রামুর ঈদগড়ের মাওলানা হাবিবুর রহমান, গর্জনিয়ার হাজিরপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে অস্ত্রধারী অন্তত ১৮ জনের একটি দস্যু বাহিনী। এর পর কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশের যৌথ অভিযানের পরও অপহরণকারীরা কৌশলে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে ৩০ ঘন্টা পর তাঁদেরকে ছেড়ে দেয়।
অপহরণকারীদের কবল থেকে প্রাণে রক্ষা পাওয়া নুরুল কবির রাশেদ বলেন, মুক্তিপণের জন্য তাঁরা ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে। অন্যতায় মেরে ফেলত। সন্ত্রাসীদের কাছে ভারী অস্ত্র আছে। বি-বাড়িয়া, নোয়াখালি, মহেশখালী, ফটিকছড়ি ও বাঁশখালীর লোকজনও তাঁদের দলে রয়েছে। অপহরণকারীরা মূলত পেশাদার ডাকাত বলে মনে হয়েছে। তাঁদের কাছে দশ দিনের খাবারও মজুদ ছিল।
এর আগে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি বিকালে বাড়ির পাশে খেলা করার সময় রামুর গর্জনিয়ার বড়বিল গ্রাম থেকে মোহাম্মদ ফোরকানের ছেলে মোহাম্মদ হাসান শাকিল (১০) ও মোহাম্মদ হোছাইন কাজলকে (৮) অপহরণ করে মুক্তিপন আদায় করতে না পেরে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার পর থেকে সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রামু উপজেলার কিছু অংশ এবং কক্সবাজার সদরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ঈদগাঁও-ঈদগড়-বাইশারী সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় বাইশ কিলোমিটার। সড়কের বাইশারী অংশে করলিয়ামুরা, বৈদ্যপাড়া, অলির ঝিরি, বেংডেপা, হাতিবান্ধা, হাজির পাড়া, ঈদগড় অংশে ধুমছাকাটা, হাসনাকাটা, অর্জুন বাগান, মোকতারের দোকান সংলগ্ন এলাকা এবং ঈদগাঁও অংশে পানের ছড়া, ছনখোলা, গজালিয়া, হিমছড়ি ও ভোমরিয়া ঘোনা ঢালায় মূলত ডাকাতি হয়। সপ্তাহে রবি ও বুধবার বাইশারীতে, সোম ও শুক্রবার ঈদগড়ে এবং শনি ও মঙ্গলবার ঈদগাঁও বাজারে হাট বসে। হাটের দিন অন্তত ২৫-৩০ হাজার লোক এ সড়কে চলাচল করেন। তাই হাটের দিন ডাকাতি বেশি হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৯ নভেম্বর সড়কের পানেরছড়া ঢালায় ডাকাতি প্রতিরোধ করতে গিয়ে ঈদগড় পুলিশ ফাঁড়ির সুবেদার নায়েক সুষম চাকমা ডাকাতের গুলিতে মারা যান। এর আগে ২০০৭ সালে মারা যান ধুমচাকাটা গ্রামের মৃত ফরিদুল আলমের ছেলে জাকের হোসেন (২৪) ও মৃত মোজাফ্ফর আহাম্মদের ছেলে মোঃ সোলাইমান সিকদার (৬০)। গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো মানবেতর জীবন যাপণ করছেন টুটার বিলের রশিদুজ্জামানের ছেলে আবুল কাশেম, রেনুরকুলের আব্দুর শুক্কুরের ছেলে নুরুল হুদাসহ অন্তত বিশ জন।
স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদগড়, বাইশারী, গর্জনিয়া এবং পাশের ঈদগাঁও এলাকায় অপরাধ কর্মকান্ডে মূলত তিনটি গ্রুপ সক্রিয় আছে। এর মধ্যে করলিয়া মুরার আব্দুল করিম, আমির হামজা, বৈদ্যপাড়ার জসীম উদ্দিন, করলিয়ামুরার আব্দুর রশিদ, পশ্চিম হাসনাকাটার আইয়ুব আলী, ফরিদ মিয়া, হাসনা কাটার ফারুক মিয়া এবং বাইশারী লম্বাবিলের আব্দুর সবুর সহ ২৫-২৬ জনের একটি গ্রুপ ঈদগড় ও আশপাশের এলাকায় অব্যাহতভাবে ডাকাতি ও অপহরনের ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। এ সব ডাকাতদের বিরুদ্ধ থানায় একাধিক চুরি ডাকাতি ও অপহরনের মামলা রয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীর বাসিন্দা ও সেনাবাহিনীর (অবঃ) সার্জেন্ট আবদুল হামিদ বলেন,মূলত ১৫টি স্থানে ডাকাতি ও অপহরনের ঘটনা ঘটলেও সড়কের রামুর ঈদগড় অংশে অর্জুন বাগান, পানেরছরা ঢালা এবং কক্সবাজারের ঈদগাঁও অংশে ছনখোলা, হিমছড়ি ভোমরিয়াঘোনা ও গজালিয়া ঢালায় ডাকাতি হয় বেশি। অর্জুন বাগান থেকে ভোমরিয়া ঘোনা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটারের মধ্যে দুই স্থানে নিয়মিত পুলিশ থাকলেও ডাকাতি ও অপহরণ রোধ সম্ভব হচ্ছে না।
একাধিক সূত্র বলছে, ঈদগড়ের আবুশামা, তার ছেলে ও জামাতা ওই এলাকার প্রসিদ্ধ অস্ত্র কারিগর। এরা বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকায় তারা আবার ছাড়া পেয়ে যান। ফলে এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। গত ১৮ অক্টোবর বিকালে ঈদগড়ের পানিষ্যা ঘোনা এলাকা থেকে ৩টি দেশীয় তৈরি অস্ত্রসহ জান্নাতুল ফেরদৌস (৪০) নামে এক মহিলাকে আটক করেছে রামু থানা পুলিশ। সে কোদালিয়া কাটা গ্রামের সাহাব উদ্দিনের স্ত্রী।
এ ঘটনার পর রামু থানার ওসি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, আবারো ঈদগড়ের গহীন অরণ্যে অস্ত্র কারিগররা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ধরনের অস্ত্র পাচার কাজে তারা ব্যবহার করছে স্ত্রী ও আপনজনদের। সহজেই চিহ্নিত করা যাচ্ছেনা পাচারকারীদের। এ কারণে অজান্তে অনেক অস্ত্র পাচার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আটক হওয়া অস্ত্র পাচারকারী জান্নাতুল ফেরদৌস তার ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতরে লুকিয়ে ৩টি অস্ত্র চট্টগ্রামে বিক্রির জন্য যাচ্ছিল বলে অকপটে স্বীকার করেছে।
তাছাড়া সপ্তাহ খানেক আগে রামু উপজেলা পানেরছড়া থেকে ডিবি পুলিশ ছেনুয়ারা নামে অপর একটি মহিলার ব্যাগ থেকে একটি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
বাইশারী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবু মুছা বলেন, বাইশারী-ঈদগড়-ঈদগাও সড়কে ডাকাতি ও অপহরণ প্রতিরোধে পুলিশ দৃড় প্রত্যয় নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীরা আর রেয়াহ পাবে না।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ শনিবার রাতে টেলিফোনে আমাদের রামু কে বলেন, সম্প্রতি ঈদগড় থেকে ছাত্রলীগ নেতাসহ তিন ব্যাক্তি অপহরণের ঘটনায় রামু থানায় মামলা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশী তৎপরাতা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও ঈদগাঁও-ঈদগড়-বাইশারী সড়ক দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরাপদ হয়ে উঠবে বলেও আশ্বস্ত করেন জেলার এই পুলিশ প্রধান।