অবশেষে মনভাঙা খবর নিয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে বৃহস্পতিবার দেশের পথে রওনা হয়েছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সাহিত্যের সব অঙ্গন সমান দক্ষতায় জয় করতে পারলেও ফুসফুসে জেঁকে বসা ক্যান্সারটাকে পরাজিত করা সম্ভব হলো না তার। লন্ডনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাকে ছয় মাসের সময় বেঁধে দিয়েছেন। লন্ডন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এ তথ্য জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাট্যজন ও ঢাকা থিয়েটারের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ। আজ শুক্রবার ঢাকায় পৌঁছাবেন তিনি।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।
ওই স্ট্যাটাসে নাসির উদ্দিন ইউসুফ লেখেন, ‘সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক লন্ডন এসেছিলেন ফুসফুসে কর্কট রোগের চিকিৎসার জন্য। প্রায় তিন মাস ( প্রকৃতপক্ষে সাড়ে চার মাস) অসফল চিকিৎসার পর ফিরে যাচ্ছেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। ডাক্তারদের মন খারাপ করা ঘোষণা—মাত্র ছ’মাস বাঁচবেন কবি। জীবনের এ অন্তিমকাল কবি কাটাতে চান নিজ বাসভূমে। জল-কাদায় নিমগ্ন বাংলাদেশে। বন্ধু-স্বজন সান্নিধ্যে। বাংলা শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রধানতম এ কবি নাট্যকার বিজয়ীর মত ফিরে গেলেন মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে। চোখে অশ্রু, মুখে নুতন নাটক লেখার প্রত্যয় নিয়ে ধীরে অপেক্ষমান বিমানে আরোহন লক্ষ্যে অদৃশ্য হলেন প্রিয় হকভাই। পেছনে আমরা মন খারাপ করে হিথ্রো বিমানবন্দরে পড়ে থাকলাম ।’
তবে ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারের ভয়ে ভীত নন বাংলাদেশের সাহিত্যের এই প্রধান লেখক। সম্ভাব্য নিয়তিকে মেনে নিয়েই তিনি বীরের মতো লিখে যাচ্ছেন তার সম্ভাব্য শেষ নাটক ‘শেষ যোদ্ধা’। হিথ্রো বিমানবন্দরে বিদায়বেলায় নাসির উদ্দিন ইউসুফকে এ তথ্য জানিয়েছেন নিজেই। ইউসুফ ওই স্ট্যাটাসে সে তথ্যের উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘কানে তখনো বাজছে তার শেষ কথা,”নূতন নাটক লিখছি নাম ‘শেষ যোদ্ধা’।” গাড়িতে ফেরার পথে মুঠোফোনে হক ভাইয়ের ই-বার্তা, “তোমার সাথে নাটক করবো। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”
প্রসঙ্গত: দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগতে থাকা সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে সস্ত্রীক লন্ডনে গিয়েছিলেন এ বছরের ১৫ এপ্রিল। একইসঙ্গে যুক্তরাজ্যেরও নাগরিক হওয়ায় লন্ডনে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষের (এনএইচএস) নিয়মিত চিকিৎসকের (জিপি) মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করান তিনি। এরপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ম্যাকডোনাল্ডের তত্ত্বাবধানে লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি। পরে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ নিউসাম ডেভিসের তত্ত্বাবধানে চেলসি অ্যান্ড ওয়েস্টমিনস্টার হাসপাতালে কেমোথেরাপি নেন। কিন্তু টানা সাড়ে চার মাসের চিকিৎসা শেষে মন খারাপ খবরই দিয়েছেন তাকে সেদেশের চিকিৎসকরা।
উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্ম করেন। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সব শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।
প্রখ্যাত এ সাহিত্যিক সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও হালিমা খাতুন দম্পতির আট সন্তানের প্রথম সন্তান। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক এ লেখক ব্যক্তিজীবনে প্রথিতযশা লেখকা ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হকের স্বামী।
সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী, তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সেখানে ‘উদয়াস্ত’ নামে তার একটি গল্প ছাপা হয়।
তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। এরপর ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
সৈয়দ শামসুল হকের পিতা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। কিন্তু, লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সৈয়দ হক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার বদলে ১৯৫১ সালে বম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেকের বেশি একটি সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়।
এ পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৬) ছাড়াও একুশে পদক (১৯৮৪), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৯), অলক্ত স্বর্ণপদক (১৯৮২), আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ (১৯৮৩) অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
(ব্যবহৃত ছবি নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও লন্ডনে হিথ্রো বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকা প্রবাসী অনুজিত সরকারের ফেসবুক পাতা থেকে সংগৃহীত)