সুনীল বড়ুয়া:
হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়াও গর্ব করার মত নানা বিষয় ছিল রামুকে ঘিরে। বিশেষ করে প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীতে তৈরী অনন্য সুন্দর বৌদ্ধ পূরাকীর্তির কারণে সারা দেশের বৌদ্ধদের তীর্থস্থান ছিল এই রামু। বলা হত রামু বৌদ্ধ মন্দিরের জন্য বিখ্যাত,সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পাদপীঠ রামু। কিন্তু গত ২৯ সেপ্টেম্বর কিছু দুর্বৃত্তের ধংসযজ্ঞে এক রাতেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেল রামুবাসীর হাজার বছরের গর্বের ধন,সম্প্রীতি। পুড়ে ছাই হয়ে গেল বৌদ্ধ এতিহ্য। পূরাকীর্তি নয়, এখন পোড়া কীর্তির শহর রামু।
এসব ধংসস্তুপ নিয়েই রামু এখন দর্শনীয় স্থান। অনেকে হাস্যরসের সাথে এখন বলছেন ‘বৌদ্ধ মন্দির পোড়ানোর জন্য বিখ্যাত রামু’। রামুতে সরকারি উদ্যেগে পুড়ে যাওয়া বিহারগুলো নতুন করে তৈরীর কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে তৈরী করা হয় এসব বিহার। কিন্তু এসব পাকা স্থাপনায় কি গর্ব করার মত সেই প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। সিদ্ধ কাঠের উপর রেংগুনি কারুকাজ, উচু অভ্রভেদি চূড়া,সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম কারুকাজে দৃষ্ঠিনন্দন সব শিল্পকর্ম,যেগুলো সংবেদনশীল মানুষকে কাছে টানত?। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রাচীন এ ঐতিহ্য কি আর ফিরে পাওয়া যাবে?। এ ক্ষতি কোনভাবে পূরণ হবার নয়।
শুধু তা নয়,দীর্ঘদিন মুসলমান,হিন্দু,বৌদ্ধ সোহার্দ্য সম্প্রীতির মাঝে বসবাসের কারণে একে অপরের প্রতি যে আস্থাশীলতা তৈরী হয়েছিল সেই রাতে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে তাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যে প্রতিবেশী বিহারে আগুন দিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে,যে বুদ্ধমূর্তির চোখ উপড়ে নিয়েছে,লুট-পাট করেছে,তার প্রতি বিশ্বাস কি আদৌ ফিরে আসবে?। আসলেও সময়ের ব্যাপার। তাই রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে এখন গভীরভাবে বিরাজ করছে আস্থার সংকট। ঘটনার সুষ্ঠুু বিচার না পাওয়ার ভয়।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারে ছিল প্রায় তিনশ বছরের পুরনো সংগ্রহশালা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ (ধাতু),বাংলা,পালি,হিন্দী,বার্মিজ,শ্রীলংকান ভাষায় তাল পাতার উপর লেখা পাঁচ হাজারেরও বেশী ত্রিপিটক ও পূঁথি গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল সীমা বিহারের সংগ্রহশালায়।স্বর্ণ-রোপ্য, কষ্ঠি পাথর, শ্বেতপাথর,চন্দন কাঠের তৈরি চার শতাধিক বুদ্ধমূতিসহ বৌদ্ধধর্মীয় আরও বিরল কিছু কিছু সংগ্রহের কারণে এটি ছিল বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মিনি জাদুঘর। সেই রাতে দুস্কৃতিকারীদের তান্ডবে নিমিষের পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এসব প্রাচীন অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ।
জানা গেছে, ১৭০৬ সালে বিহারটি প্রতিষ্ঠার পর শুরু হয় সংগ্রহের কাজ। শুরুর দিকে তৎকালীন বিহারাধ্যক্ষ আর্যবংশ মহাথের সংগ্রহশালার কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে বিশুদ্ধাচার মহাথের এবং বর্তমানে পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরো এ সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। সত্যপ্রিয় মহাথেরর বয়সও এখন ৮৬ বছর। বিশ বছর বয়সে তিনি ভিক্ষু জীবন গ্রহন করেন। তাঁর প্রায় ৬৩ বছরের ভিক্ষু জীবনে দেশ বিদেশ থেকে সংগৃহিত সমস্ত কিছুই সংরক্ষিত ছিল এই সংগ্রহশালায়। এখানে ছিল বৌদ্ধ ধর্মীয় তাঁর নিজের লেখা অপ্রকাশিত অনেক পান্ডুলিপি। ছিল দেশ বিদেশে পাওয়া সন্মাননা ক্রেষ্ট। ২০০৩ সালে মিয়ানমার সরকার পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরকে অগ্গমহা সদ্ধম্মজ্যোতিকা ধজ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই উপাধিরই অংশ কাঠের উপর পাথরের কারুকাজে সুসজ্জিত আসন, সন্মাননা ক্রেষ্ঠ ও সনদটিও পুড়ে গেছে সেদিনের ধংসযজ্ঞে।
তাঁর ভিক্ষু জীবনের সমস্ত অর্জন একরাতেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেসব প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন লালন করে এতদিন বেঁচে ছিলেন সবই এখন পোড়া ছাই। সবকিছু পুড়িয়ে তাকে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে।
ইতিহাসের নানা রকম জানা-অজানা তথ্য এসব পুঁথিতে লেখা ছিল। এ ছাড়া এসব পূঁথিতে গৌতম বুদ্ধের অনেক বাণী এবং তাঁর অনুসারীদের বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ ছিল পালি ভাষায়। পুঁথিগুলোর পরতে পরতে ছিলো বৌদ্ধধর্মের কৃষ্টি-কালচার। কিন্তু এগুলো ভস্মীভূত হওয়ায় এ অঞ্চলের ইতিহাস ও বৌদ্ধধর্মের বিষয়ে অনেক মূল্যবান তথ্যই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে এ সংগ্রহশালার রক্ষনাবেক্ষন ও দেখভাল করে আসছিলেন তাঁরই শিষ্য প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু। দিনের পর দিন পরম যত্নে গর্বের অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণ করে আসছেন সেগুলো হারিয়ে তিনিও নির্বাক। যে পাত্রটিতে সংরক্ষিত ছিল বুদ্ধের পবিত্র দেহাবশেষ (ধাতু),সেই পাত্রের ধংসাবশেষ দেখিয়ে তিনিই বললেন, ভাবতেই পারিনা, ও গুলো এখন নেই। এ সম্পদ শুধু বৌদ্ধদের নয়,বাংলাদেশের । এ ক্ষতি কোনভাবেই পোষানো যাবেনা।
শুধু সীমা বিহারের সংগ্রহশালায় নয়,হিংসার আগুনে পুড়ে যাওয়া,রামু মৈত্রী বিহার,উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র,লাল চিং, জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার,উখিয়ারঘোনা জেতবন বিহার,চাকমারকুল অজান্তা বৌদ্ধ বিহার ,অপর্ণাচরন বিহার এবং ভাংচুর ও লুটপাটের শিকার চেরাংঘাটা বড় ক্যাং-এও সংরক্ষিত ছিল এরকম অনেক অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর শামসুল হোসাইন বললেন,‘রামুসহ এ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো শুধু বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদেরই নয়, এটি বৃহত্তর সংস্কৃতির অঙ্গ। কিন্তু এ বৈচিত্র্যকে আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। এগুলো নষ্ট করার মাধ্যমে আমাদের দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে আমরা দীনতার মধ্যে পড়ে গেলাম’। তিনি আরও বলেন,সরকার কক্সবাজার অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলো কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। কক্সবাজার এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের মাধ্যমে বাকি নির্দশনগুলো রক্ষার দাবিও জানান তিনি।
লেখকঃ সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
সংবাদ পাঠক ও অনুষ্ঠান ঘোষক,বাংলাদেশ বেতার,কক্সবাজার।