সুনীল বড়ুয়া:
‘দূর হোক সাম্প্রদায়িকতা,সম্প্রীতির সমুজ্জ্বল সুবাতাসে উদ্ভাসিত হোক নাগরিক জীবন’ এই আহবানে দিনব্যাপী নানা আয়োজনে স্মরণ করা হলো রামু সহিংসতার চার বছর।
সংঘদান ও অষ্ট উপকরণ দান,ধর্মসভা,মৈত্রী শোভাযাত্রা,আলোক চিত্র প্রদর্শনী,রক্তের গ্রুপ নির্ণয়সহ দিনব্যাপী নানান আয়োজন শেষে সন্ধ্যায় মঙ্গল প্রদ্বীপ প্রজ্বলনের মধ্যদিয়ে শেষ হয় দিনব্যাপী আয়োজন। দিনের সকল আয়োজনেই ছিল অসাম্প্রদায়িক সুর,সম্প্রীতির জয়গান।
সাম্প্রদায়িকতা দূরীভুত হয়ে জগতের সকল প্রাণী মঙ্গল আলোয় উদ্ভাসিত হোক,এই ছিল পুরো অনুষ্ঠানের প্রার্থনা। বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রামু লালচিং-মৈত্রী কমপ্লেক্সে দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ।
আয়োজকেরা জানান,২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সেই অশুভ দিনে ধ্বংসপ্রাপ্ত পবিত্র বুদ্ধের ধাতু,বুদ্ধমূর্তি,বৌদ্ধ বিহার,পবিত্র ত্রিপিটক হারিয়ে যাওয়া সকল স্মৃতির উদ্দেশ্যে পুণ্যদান করতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
রামু লালচিং-মৈত্রী কমপ্লেক্সের সাদাচিং এ বুদ্ধের সামনে অর্ঘ্যদানের মধ্যদিয়ে শুরু হয় দিনব্যাপী আয়োজন। এর পর সকালে শুরু হয় মহা সংঘদান ও অষ্ট উপকরণ দান ও সদ্ধর্ম সভা। দুপুরে অতিথি ভোজনের পর্ব শেষে বেলা তিনটার দিকে অনুষ্ঠানস্থল থেকে বের করা হয় মৈত্রী শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি রামুর প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে একইস্থানে এসে শেষ হয়। এর পর বিকালে একইস্থানে আবার চলে সদ্ধর্ম সভা।
এতে সভাপতিত্ব করেন,বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপসংঘরাজ ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের। প্রধান ধর্মদেশক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যভাষা পালি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. জিনবোধি মহাথের। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু ড. ধর্মসেন মহাথের উপস্থিত থাকার কথা থাকলে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি।
ধর্মসভায় অন্যান্যদের মধ্যে,শ্রীকুল রাখাইন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ পাঞাদ্বীপা মহাথের, দ্বীপ শ্রীকুল ধর্মর বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ উপাঞাচারা মহাথের,রামু মৈত্রী বিহারের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাতিলোক মহাথের, হাজারীকুল বোধিরতœ বৌদ্ধ বিহারের প্রজ্ঞাবোধি থের,রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ জ্যোতিসেন থের প্রমুখ ধর্ম দেশনা করেন।
রামু সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন, রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আবায়ক রজত বড়ুয়া রিকু শুভেচ্ছা বক্তব্যদেন স্মরণ সভা উদযাপন পরিষদের আহবায়ক রিটন বড়ুয়া,এমইউপি ও সদস্য সচীব পূর্ণধন বড়ুয়া।
অনুষ্ঠানে সারা দেশের শতাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রামণ এবং হাজারো বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকা অংশ নেন। ধর্মসভায় সকল বক্তা আস্থার সংকট কাটিয়ে হারানো সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার উপর জোর দেন।
দিনব্যাপী এ আয়োজনে স্থানীয় রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ ছাত্র পরিষদ-উদ্যেগে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও সেই কালো রাত ২৯ সেপ্টেম্বর অবলম্বনে স্থির চিত্র ও ভিডিও চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়ায় রামু ত্রিরত্ন মহিলা সংঘ।
রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহ্বায়ক রজত বড়ুয়া রিকু জানান, আমাদের এবারের আয়োজনের আহবান ছিল, ‘দূর হোক সাম্প্রদায়িকতা,সম্প্রীতির সমুজ্জ্বল সুবাতাসে উদ্ভাসিত হোক সকল নাগরিক জীবন’ মূলত ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের মত আর কোনো বিভিষিকাময় রাত আর কোন জাতীর জীবনে না আসুক,এই কামনা এবং সেদিনের রাতে ধব্ংসপ্রাপ্ত সকল বুদ্ধমূর্তির উদ্দেশ্যে পুণ্যদান করতে এসব আয়োজন করা হয়।
উল্লেখ্য সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের একাউন্টে পবিত্র কোরান শরীফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধপলীতে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় রামুর প্রাচীন ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলা লুটপাট ও ভাংচুর চালানো হয় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে।
পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর বিকালে উখিয়ায় আরো চারটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালানো হয়েছে। সেই হামলার ক্ষতচিহ্ন মুছে বর্তমান সরকার এক বছরের মধ্যে ১৯টি বৌদ্ধ বিহার পূণনির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেই ধ্বংস স্তুপের উপর দৃষ্ঠিনন্দন এসব বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী । সেই হামলার চার বছর পূর্ণ হয়েছে আজ।