এখন স্লোগান উন্নয়ন। এ উন্নয়ন অর্থ জিডিপি বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান একরৈখিক। অর্থাৎ অন্যান্য বিষয় এখন আর অগ্রাধিকার পাবে না জিডিপি বৃদ্ধির কৌশল ছাড়া। সত্যি বলতে কী, ৫০ বছর আগে ভাবিনি এই বাংলাদেশ দেখে যেতে পারব। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, পারেননি। তাঁর কন্যা সে অভাব খানিকটা হলেও পূরণ করেছেন। ৫০ বছর আগে ঢাকা থেকে আমার গ্রামে পৌঁছতে লাগত প্রায় আট ঘণ্টা বা তারও বেশি। এখন লাগে দুই ঘণ্টা। মানুষ ক্ষুধার্ত নেই, মঙ্গাও নেই। দুটি কাপড়, পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেল সবার আছে। ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থা এ রকম ছিল না। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বমণ্ডলে বাংলাদেশ বা শেখ হাসিনা অপরিচিত নন। মানুষ অশান্তিতে আছে, এ কথাও বলা যাবে না। এবং এর সব কৃতিত্ব শেখ হাসিনার প্রাপ্য।
এখন ভোটের রাজনীতি প্রধান রাজনীতি। আওয়ামী লীগেও এখন ডান-বাম সবাই বিচরণ করছে। সবাই বঙ্গবন্ধুপ্রেমী, শেখ হাসিনাপ্রেমী তো বটেই। আগে তাঁরা বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত বা বাম দল করেছেন। অবস্থা এখন এমন যে মন্দিরে হামলাকারী, বিএনপির বিভিন্ন সংগঠনকারীরাও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন, এমন অভিযোগও পাওয়া যায়। প্রতিটি দলে একজনই নেতা। ৫০ বছর আগে এ রকম দল বদলকারী খুব কম ছিল। সর্বস্তরেই সমষ্টিগত নেতৃত্ব ছিল। এখন তা নেই। সে কারণে দলগুলোতে গণতন্ত্র কাঠামোর কম জোর। আদর্শ এখন খালেদা জিয়া, না হলে শেখ হাসিনা। প্রতিটি দলই যখন ক্ষমতায় গেছে, তখন দেখা গেছে বিপদে যাঁরা দলে ছিলেন, ক্ষমতার সময় তাঁরা নেই। এটি একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ানোতে সরাসরি অর্থ প্রভাবের বিনিময়ে বেশির ভাগ দলীয় পদ লাভ করছেন। মনোনয়নে টাকা দিতে হয়। অর্থ ছাড়া গণতন্ত্র এখন ৫০ বছর পর জাতীয়তাবাদের কথা আর বিবেচনায় আসে না। সমাজতন্ত্র বাদ, কিন্তু ওয়েলফেয়ার স্টেটের চিন্তা-ভাবনাও এখন নেই। দেশে জিডিপি বাড়ছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, সবাই কেন বাইরে চলে যেতে চাচ্ছে। ধনী-দরিদ্র সবাই এ বিষয়ে একমত। এত টাকা মানি লন্ডারিং হচ্ছে, সবাই জানে, কেউ কোনো কথা বলে না কেন? কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, সেটি উন্নয়নের মাপকাঠি ধরা যেতে পারে। ধরা যাক, এক লাখ লোকই কোটিপতি। বাকিদের সঙ্গে অসাম্য এত বেশি কেন তাহলে? পুঁজিবাদী ও বাজারব্যবস্থায় এত বেশি অসাম্য থাকবে কেন? পুঁজিবাদী ও বাজারব্যবস্থায় অসাম্য থাকবে কিন্তু সেই অসাম্য আগের চেয়ে বাড়বে কেন? এখনো মৌলভিরা ফতোয়া দেন দোররা মারার, তিন তালাকের। স্যুট-টাই পরা মানুষের মন মধ্যযুগীয়। অবসর নেওয়ার পর প্রগতিশীল বলে খ্যাত মানুষও প্রথম মাদরাসা বা মসজিদ তৈরি করেন। মেয়েদের একটি স্কুল করেন না। আওয়ামী লীগ শাসন, যেটিকে লিবারেল শাসন বলা যায়, সে আমলেও ফেসবুক দেখলে মনে হয়, এ জাতি সভ্য হবে কবে? সিভিল সমাজ শক্তিশালী করার বদলে সব দল আমলাতন্ত্রকেই শক্তিশালী করেছে।
ভোটের কারণে এবং দক্ষিণপন্থার ভোট যাতে বিএনপি শিবিরে না যায় সে কারণে দক্ষিণপন্থার দলগুলোকে এত তোয়াজ করা হয়েছে, কোনো কোনো সময় মনে হতে পারে আওয়ামী লীগ উদার বা বাম থেকে দক্ষিণপন্থায় বেশি ভালোবাসে। সরকার কখনো ভাবেনি প্রতিটি উপজেলায় একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও শিল্পকলার একটি শাখা খুলতে হবে। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক, এ কথা এখনো কেউ তুলবে না। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগ কী হবে জানি না। কারণ তারপর এমন কোনো নেতা নেই যিনি গ্রহণযোগ্য। এ দিক থেকে বলতে গেলে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সম্মান অক্ষুণ্ন রেখেছেন। শত সমালোচনার পরও বলতে হয় তিনি থাকলে আমরা ভালো থাকব।
৫১ বছর আগে দেশ যা ছিল এখনো তা থাকবে, এটি ভাবা কষ্ট-কল্পনা। গত ৫০ বছরে দেশের যে পরিবর্তন গত ২০০ বছরেও এত দ্রুত সে পরিবর্তন হয়নি। আমাদের জেনারেশনও যাওয়ার পথে। আফসোস, এই ৫০ বছরে জাতীয় চরিত্রের অবনমন হয়েছে। দুর্নীতি বা চুরি যে অপরাধ বেশির ভাগই এখন তা মনে করে না। মনে করে এটি প্রাপ্র্য। আমাদের গণহত্যা জাদুঘরের এক হিসাবরক্ষককে প্রতি কিস্তিতে একটি অফিসে তাঁর ভায়রাকে ঘুষ দিয়ে আসতে হতো। এবং আমরা চাঁদা তুলে দিতাম। তাদের দৃঢ় ধারণা, আমরা সবাই প্রকল্প থেকে টাকা লোপাট করি। এ ধরনের জাতীয় ধারণা আগে ছিল না। এবং অপরাধীরা প্রায় কখনো শাস্তি পায় না। শাস্তি পেলেও সম্পদ অক্ষুণ্ন থাকে এবং তারা তো তা-ই চায়। রাজনীতিতে কাগজে-কলমে আদর্শ আছে, কার্যক্রমে নেই। যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা একটি আদর্শের মুখোশ পরেন মাত্র। একটি উদাহরণ দিই। বলা হয়ে থাকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তাঁরা আত্মত্যাগে গিয়েছিলেন। যাঁরা ফিরে এসেছিলেন তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল করলেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে তাঁরা স্লোগান দিলেন জিয়ো জিয়ো জিয়াউর রহমান। যাঁরা বঙ্গবন্ধু ভক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন জিয়া ভক্ত। এরশাদ ক্ষমতায় এলে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধার উপাধি দিলেন রণবীর। খালেদা জিয়ার সময় তাঁরা হলেন খালেদা ভক্ত। এখন সবাই হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু ভক্ত। এই যদি শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অবস্থান হয়, তাহলে আপামর জনগণের অবস্থা কী? বঙ্গবন্ধুর দেশে ৫১ বছর পর কমপক্ষে ৪০ শতাংশ লোক পাকিস্তানি ধারায় বিশ্বাসী। দেশটি যাতে মৌলবাদী হয় তাতে তারা আগ্রহী।
সংবিধানে চারটি মূলনীতি আছে। তা এখন আর কারো মনে নেই। প্রয়োজন না হলে কেউ সংবিধানের তোয়াক্কা করে না। শেখ হাসিনা বা আমরা না থাকলেও তিনি দেশকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, দেশ সে পর্যায়ের নিচে নামবে না। ৫২ বছরে এটি দেখে শুধু শান্তি। অশান্তি হচ্ছে, ‘উন্নয়ন’ হলো কিন্তু শিক্ষা-সংস্কৃতির জিডিপি বাড়ছে না। ‘আদর্শ’ একটি অপাঙক্তেয় শব্দ। রাজনীতি হচ্ছে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকা ও লুটপাটে সহায়তা করা।
৫১ বছর পর আমরা সম্মুখীন হয়েছি প্রবল নৈতিক সংকটের। এ সমাজের সর্বস্তরে এই সংকট এখন প্রবল এবং তা দেশপ্রেমের বিরোধী। শেখ হাসিনার মতো জনদরদি রাজনীতিবিদ কর্তৃত্বে থাকার পর এই অবস্থা হলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চাই না। তবে ৫১ বছর পর সবই কি নেতিবাচক? মোটেই না। ১৯৭১ সালে যখন অস্তিত্ব বিপন্ন তখনো আমরা আশা রেখেছি জিতব। এখন দেশ একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে। নতুনরা নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আসবে। চোরদের সম্মান করার ব্যাপার সমাজ-রাষ্ট্র থেকে অপসৃত হবে, এই আশা কেন করব না। বাঙালি সব সময় পরস্পরবিরোধী। সব ব্যক্তি সব সময় ষড়যন্ত্রের শিকার। যার কাছে যা আশা করি না, তিনি তা-ই করেন। তার পরও বলব বাঙালি সজীব। আর সে কারণেই বাঙালির বাংলাদেশের অন্য নাম আশা।
লেখক : বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র : কালের কণ্ঠ