কৃষকের মাঠ ফসল ১০ কোটি, ব্যবসায়ীদের ৫০ কোটি, সড়ক অবকাঠামো ১৫ কোটি, বাসস্থান ২০ কোটি ও গবাদি পশুসহ বিবিধ সেক্টরে ৫ কোটিসহ মোট শত কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে এবারের বন্যায়।
লামার ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা এবং বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে লামা পৌরসভা এলাকার ক্ষয়ক্ষতি ও বন্যা পরবর্তী সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময়কালে এইসব তথ্য দেন লামা পৌরসভার মেয়র উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ জহিরুল ইসলাম।
১৯ আগস্ট, শনিবার বিকেল ৩টায় লামা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে মতবিনিময় সভায় মেয়র বলেন, “বান্দরবান জেলার সব চেয়ে জনবহুল এবং জনগুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হচ্ছে আমাদের লামা উপজেলা। গত ৭,৮ ও ৯ আগস্ট প্রবল বর্ষনের ফলে উপর থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে লামা পৌরসভাসহ এ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন বন্যা প্লাবিত হয়ে পড়ে। লামার ইতিহাসে স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যার সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় লামা পৌরসভা এলাকা। মানুষের ঘর বাড়ি, দোকানপাট, কৃষি জমি ও পুকুর সমুহ টানা তিন দিন বন্যার পানিতে প্লাবিত থাকায় বন্যার ভয়াবহতায় ক্ষয় ক্ষতি ব্যপক আকার ধারন করে, যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়। বন্যাকালিন বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা করায় জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারন করে।
এক দিকে বন্যার পানিতে পুরো এলাকা নিমজ্জিত, অপরদিকে বিদ্যুৎ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক বিহীন, এমন প্রতিকূল অবস্থায় সাংবাদিকরা ছিলেন পেশার প্রতি অবিচল। এ প্রতিকুল পরিবেশে সাংবাদিকরা নিয়মিত সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করে বন্যার ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেছেন। তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
প্রায়ই প্রতি বছরই আমরা কম বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হই। এবারের দুর্যোগ ছিলো সকলের জন্য ভয়াবহ। ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে পৌরসভা এলাকা বেশি বন্যা কবলিত হয়। লামা পৌরসভার দক্ষিন পূর্ব দিকে আলীকদম উপজেলার মায়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত, পূর্ব দিকে রুপসীপাড়া এবং লামা ইউনিয়নের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত এবং উত্তর দিকে গজালিয়া ইউনিয়নের সর্বশেষ সীমান্ত পর্যন্ত এলাকার সমস্ত বৃষ্টির পানি লামা পৌরসভার লামা বাজারের পাশ ঘেষে মাতামুহুরী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়।
অতিবর্ষনের ফলে এ ব্যাপক এলাকার বৃষ্টির পানি পৌরসভার পাশ ঘেঁষে মাতামুহুরী নদী দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় সুখ-দুঃখ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে প্রবাহিত হতে না পেরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফুলে ফেফে উঠে লামা পৌর শহরসহ আশপাশের এলাকাকে প্লাবিত করে। এতে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতি হয়। এবারের বন্যায় লামা পৌরসভা এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডই প্লাবিত হয়েছে। এসময় ৮ থেকে ২৫/৩০ ফুট পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে- জনবসতি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কৃষি জমি, পুকুরসমূহ ও রাস্তাঘাট। শুধু বন্যা না, প্রবল বর্ষনের ফলে বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বসে অসংখ্য ঘর-বাড়ি বিধস্থ ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ ভয়াবহ বন্যায় লামা পৌরসভা এলাকায় শত কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। লামা পৌরসভার ৯ টি ওয়ার্ডে সাড়ে ৪ হাজার পরিবার বন্যা কবলিত ও পাহাড় ধ্বসে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তার মধ্যে সম্পূর্ণ ঘর বিধ্বস্থ হয় ২ শত পরিবার। আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৫শ’ পরিবার। লামা বাজার এবং এর আশপাশ এলাকার প্রায় ১ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়। এ সকল ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০ ভাগ ব্যবসারীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুক্ষিন হন। আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সড়ক ভেঙে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ৮০ ভাগ আবাদী জমির ফসল নষ্ট হয়েছে । বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ব্যপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। অসংখ্য গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী বন্যায় ভেসে গেছে। এলাকার প্রায় ৯০ ভাগ রিংওয়েল বন্যার পানিতে ডুবেছে। পার্বত্য মন্ত্রীর দিক নির্দেশে আমরা বন্যা এবং পাহাড় ধসের এ ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছি। বন্যা পূর্ববর্তী সময়ে আমরা মাইকিং করে লোকজনকে নিরাপদে কিংবা অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র সমুহে আশ্রয় গ্রহন করার অনুরোধ করেছি। বন্যায় প্লাবিত লোকজনকে উদ্ধার করে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে এসে সেখানে তাদের প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করেছি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী সকলের প্রাণপ্রিয় নেতা বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি বন্যা চলাকালিন সময়ে প্রতিটি মুহুর্তেই লামাবাসীর খোঁজ খবর নিয়েছেন। মন্ত্রী মহোদয়ে নির্দেশে বন্যা পরবর্তী সময়ে এর ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছি।
অত্যান্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে লামা বাজারের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন গলি ও আভ্যন্তরীণ সড়ক সমূহ পরিস্কার করে লোকজনের চলাচল উপযোগি করে তোলা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় নিজেই বন্যা কবলিত পৌরসভা এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণকে দেখতে ছুটে এসেছেন। মন্ত্রী মহোদয়ের মাধ্যমে ইতিমধ্যে বন্যা কবলিত ২ হাজার ৯ শ পরিবারের মাঝে খান্য শস্য এবং ২শ পরিবারের মাঝে নগদ অর্থ ১০ লাখ টাকা বিতরণ করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সকল ধরনের সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে।
লামা পৌরসভা এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের সহায়তায় ইতিমধ্যে বেসরকারি উদ্যোগে যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এছাড়া দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, লামা উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনকে আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ দুর্যোগের সময় পৌরসভার বন্যা কবলিতদের মানবিক সহায়তা করার জন্য সার্বক্ষিন পাশে ছিলেন তারা। দুর্যোগে, দুর্দিনে আগামীতেও আমরা সকলে এক সাথে কাজ করবো। এ দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সকলের পরামর্শ এ সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি”।
এ সময় লামা পৌর মেয়র পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি’র সুস্থ্যতা করে করে সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। এর আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে মন্ত্রীর প্রতিনিধি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদীপ কান্তি দাশও মন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য কামণায় সকলের নিকট আশির্বাদ কামণা করেন। সংকটকালীন সময়ে সাংবাদিকদের সমাজ সেবামূলক কাজের ও মেয়র কর্তৃক প্রদত্ত প্রণোদনা দানের জন্য মেয়রকে ধন্যবাদ জানান। মতবিনিময় সভায় সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পৌর কাউন্সিলরগন উপস্থিত ছিলেন।