রংবেরঙের ফানুসে রঙিন হয়ে উঠেলো আকাশ। দূর আকাশে তারার ঝিলমিলিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল অসংখ্য ফানুস বা আকাশ প্রদীপ।
মিটি মিটি আলো ছড়ালো আকাশজুড়ে। ফানুস যখন উড়তে উড়তে দূর নীলিমায় চলে যায়, তখন কোনটি তারা কোনটি ফানুস বোঝাই মুশকিল!
পূর্ণিমার আলো ঝলমল সন্ধ্যায় আকাশের মনোরম এ দৃশ্য অন্যরকম ভালোলাগার আবেশ ছড়ায় মনে। পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা উদ্বুদ্ধ হন ধর্মীয় চেতনায়, নত হন এক অন্যরকম শ্রদ্ধায়— বলছিলাম ঐতিহ্যবাহী ফানুস উৎসবের কথা।
প্রতি বছরই প্রবারণা পূর্ণিমার দিনে কক্সবাজারের বৌদ্ধ পুরাকীর্তির শহর রামুর বৌদ্ধ পল্লিগুলোতে আয়োজন করা হয় ফানুস উৎসবের। সন্ধ্যার আকাশে ফানুস বা আকাশ প্রদীপ উত্তোলনের এমন দৃশ্য দারুণ মুগ্ধতা ছড়ায় সবার মনে। রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার মাঠে এবারের ফানুস উৎসবের আয়োজন ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম।
প্রতিটি ফানুসে ছিল শিল্পের ছোঁয়া। শিল্পীর রংতুলির আঁচড়ে ফানুসগুলো হয়ে ওঠে একেকটি শিল্প কর্ম, যা উৎসবে বৈচিত্র্য এনেছে, বাড়িয়েছে ভাবগাম্ভীর্য।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতে, আকাশে ফানুস ওড়ানো কেবল বৌদ্ধদের উৎসব নয়, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। তাই ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সূত্র পাঠের মাধ্যমে ওড়ানো হয় ফানুস।
ফানুসে বৈচিত্র্য, শিল্পের ছোঁয়া
প্রতি বছর রঙিন কাগজ দিয়ে ফানুস তৈরি করা হলেও শিল্পীর রংতুলির আঁচড়ে এবারের ফানুসগুলো পেয়েছে আলাদা বিশেষত্ব, পেয়েছে শিল্পরূপ।
ফানুসে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গৌতম বুদ্ধের প্রতিবিম্ব, প্রয়াত পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরের আলোকচিত্র, মহাসুখ প্রার্থনাপূরক মহা ধাতু জাদী, শুভ প্রবারণা পূর্ণিমাসহ নানা শিল্পকর্ম; যা উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
চট্টগ্রাম থেকে এসে সপরিবারে উৎসবে সামিল হেমা তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সবকয়টি ফানুসেই অসাধারণ শিল্পকর্ম। আর এতটা আনন্দমুখর পরিবেশে ফানুস ওড়ানো হয়, দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা রণজিত বড়ুয়া বলেন, প্রবারণা পূর্ণিমার আলো ঝলমল আকাশে ফানুসের ওড়াওড়ির মনোরম দৃশ্য দেখে সবার মন ভরে যায়।
ফানুসে পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরকে স্মরণ
রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের প্রয়াত অধ্যক্ষ পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবারের ফানুসে রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ধর্মীয় গুরুর ছবি। আছে গৌতম বুদ্ধের প্রতিবিম্বও। যে কারণে এবারের ফানুসগুলো বৌদ্ধ দর্শণার্থীদের মনে মুগ্ধতার পাশাপাশি শ্রদ্ধা জাগিয়েছে আরও বেশি।
এর মধ্যে বেশি নজর কেড়েছে সত্যপ্রিয় মহাথেরের পেছন থেকে তোলা একটি আলোক চিত্র অবলম্বনে আঁকা ফানুস। যেটি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
বাংলাদেশি বৌদ্ধদের উপসংঘরাজ এই অঞ্চলের বৌদ্ধদের প্রধান বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু ও রামু সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের। ২০১৫ সালে সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর তাঁর প্রয়াণ ঘটে। প্রয়াণের বছর দুয়েক আগে সীমা বিহারের আঙিনায় হাঁটার সময় ছবিটি ধারণ করেন আলোকচিত্রী এ কে এম আতিকুজ্জামান রাসেল। এই আলোকচিত্র অবলম্বনে ফানুসের গায়ে ছবিটি এঁকেছেন চিত্রশিল্পী অনিক বড়ুয়া শাওন। ফানুসের ছবিটি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই ফানুস এবং ছবি নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন।
‘সামান্য এক ছবি আজ অসামান্য হয়ে উঠিল। জায়গা পাইল মহামতি গৌতম বুদ্ধের উদ্দেশে ওড়ানো ফানুসের গায়ে।’ নিজের ফেসবুক ওয়ালে বিষয়টি এভাবেই তুলে ধরেন আলোকচিত্রী এ কে এম আতিকুজ্জামান রাসেল।
একই পোস্টে এই আলোকচিত্রীকে উদ্দেশ্য করে বৌদ্ধ ভিক্ষু বিজয় বোধি লিখেছেন, ‘আপনি বড় ভান্তের হৃদয়জুড়ে থাকবেন। ’ পুলক বড়ুয়া লেখেন, ‘ছবির চেয়েও ফানুসে জীবন্ত’।
অন্যদিকে আলোকচিত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওই ফানুসের চিত্রশিল্পী অনিক বড়ুয়া লিখেছেন, ‘রাসেল ভাই যদি আমাদের বড় ভান্তের ছবিটি না তুলতেন তাহলে আজ আমরা এরকম একটি কাজের থিম কখনো পেতাম না। কৃতজ্ঞতা আপনাকে। ’
ফানুস কেন ওড়ানো হয়
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি, রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, “শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে রাজকুমার সিদ্ধার্থ (গৌতম বুদ্ধ) দুঃখমুক্তি লাভের আশায় রাজ্য, রাজত্ব, ভোগ-বিলাস, ধন-সম্পদ, সংসার সবকিছু ত্যাগ করে অনোমা নদীর তীরে রাজ আবরণ সারথি ছন্দককে বুঝিয়ে দিয়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন।
এ সময় ভাবলেন, ‘আমি এখন সন্ন্যাসী, রাজকীয় এ বাহারি চুল আমার কিবা প্রয়োজন’। তাই তরবারি দিয়ে নিজের চুলের গোছা নিজেই কেটে নিলেন। এবং মনে মনে ভাবলেন, ‘যদি আমার মধ্যে বুদ্ধ হওয়ার মতো পারমী থাকে তাহলে এই চুলের গুচ্ছ মাটিতে পড়বে না, আকাশেই স্থিত থাকবে’। এই সংকল্প করে চুলের গোছা উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেন রাজকুমার। আশ্চর্যের বিষয় একটি চুলও মাটিতে পড়ল না। ”
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু আরও বলেন, “বৌদ্ধ ধর্ম মতে, স্বর্গের ইন্দ্ররাজা এই চুলগুলো হীরা, মণিমানিক্য খচিত স্বর্ণপাত্রে ধারণ করে, এ চুলকে কেশ ধাতু হিসেবে স্থাপন করে তাবতিংস স্বর্গে একটি চৈত্য নির্মাণ করেন এবং এই চৈত্যের নাম রাখা হয় চুলামনি চৈত্য। সেই বিশ্বাস থেকে বৌদ্ধরা স্বর্গের সেই চুলামনি চৈত্যকে পূজা করার উদ্দেশ্যে আকাশে ফানুস বা আকাশ প্রদীপ উত্তোলন করেন। ”
মূলত আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে ফানুস উত্তোলনের যথার্থতা বেশি। তবে সেই সময় বৃষ্টিবাদল এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় প্রবারণা পূর্ণিমা বা আশ্বিনী পূর্ণিমার দিনে ফানুস ওড়ানো হয় বলে জানান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু।