সম্প্রীতির জাহাজে ফানুসের আলোয়, দূর হোক সাম্প্রদায়িক অন্ধকার। এ শ্লোগানে রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে, জাহাজ ভাসা উৎসব। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও রামুতে উদযাপিত হয়েছে জাহাজ ভাসা উৎসব। রঙিন কাগজের নান্দনিক কারুকাজে বাঁশ, বেত, কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় জাহাজ। পাঁচ-ছয়টি নৌকার ওপর বৌদ্ধ প্যাগোডা, জাদী বা চূড়া, ড্রাগন, ময়ূর, সিংহসহ বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতির জাহাজ গুলো রোববার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাসানো হয় বাঁকখালী নদীতে। বৈচিত্র্য নির্মাণ শৈলীর আটটি জাহাজে নাচে-গানে বুদ্ধ কীর্তনে বাঁকখালী নদীর এপার থেকে ওপারে ভেসে চলে। সম্প্রীতির মহাসম্মিলন জাহাজ ভাসা উৎসবে নদীর দুকূলে আনন্দে মাতোয়ারা হয় বৌদ্ধরা সহ সকল ধর্মের শত শত নরনারী।
রোববার (২৯ অক্টোবর) রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত জাহাজ ভাসা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। রামু উপজেলার হাইটুপি, শ্রীকুল, পূর্ব মেরংলোয়া, উত্তর মিঠাছড়ি, হাজারীকুল, দ্বীপ শ্রীকুল, পূর্ব রাজারকুল ও পশ্চিম মেরংলোয়া গ্রামের আটটি জাহাজ এ উৎসবে অংশ নেয়। সন্ধ্যায় ফানুস উত্তোলন উৎসব ও বুদ্ধ র্কীতনে রাত ৯টায় শেষ হয় জাহাজ ভাসা উৎসব।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, বাঙালি সংস্কৃতি, হাজার বছরের সংস্কৃতি। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থেকে মুক্তি, আমাদের স্বাধীন ভূখন্ড, একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। সকলে মিলে আমাদের যার যার ধর্ম পালন করবো। দেশকে ভালোবেসে ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলবো। এটিই ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মাঝে মাঝে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে কিছু কুচক্রী মহল ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে। ২০১২ সালে রামুতেও এ ধরণের ঘটনা ঘটেছিলো। সকল ধর্মই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের কথা বলে, ন্যায়ের কথা বলে। অন্যের ধর্মের অনুভূতির উপর আঘাত হানে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনে বুঝে, না শুনে অনেকে অন্যের ধর্মের সম্পর্কে কটু কথা বলে, অপমাননাকর বক্তব্য দিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। আমাদের সকলকে তাদের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। যারা এ ধরনের উস্কানি মুলক বক্তব্য উপস্থাপন করবে, প্রচার করার চেষ্টা করবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে তাদের বিষয়ে অবগত করবেন। সরকার তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। আমরা কখনই আইনকে নিজের হাতে তোলে নেবো না।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, রামুর জাহাজ ভাসা উৎসব দেখে আমি অভিভূত। রামুর জাহাজ ভাসা উৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহাসম্মিলন। এই আমাদের বাংলাদেশ। হাজার বছরের যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের মধ্যে রয়েছে, আমরা যে যেই ধর্মের অনুসারী হইনা কেন, যুগ যুগ ধরে আমরা এই দেশে বসবাস করছি। তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই জাহাজ ভাসা উৎসব। রামুর বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসা উৎসবে সকল ধর্মের মানুষ, সকল গোত্রের মানুষ সমবেত হয়েছেন। আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছেন।
জাহাজ ভাসানো উৎসবে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন, রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তাপ্তি চাকমা, রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা মুস্তফা, রামু থানার অফিসার ইনচার্জ আবু তাহের দেওয়ান, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহেদ সরওয়ার সোহেল, জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক মহিলা সম্পাদক মুসরাত জাহান মুন্নী, ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান টিপু সুলতান, রামু প্রেসক্লাব সভাপতি নীতিশ বড়ুয়া, উপজেলা স্বেচ্ছা সেবকলীগ সভাপতি তপন মল্লিক, সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর ছিদ্দিক, উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক রাশেদ আলী, স্কাসের চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা, রামু চৌমুহনী বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সজল বড়ুয়া, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি রামুর সভাপতি স্বপন বড়ুয়া প্রমুখ।
রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা ও জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি অর্পন বড়ুয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ উৎসবে বিশেষ বক্তা ছিলেন, কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম সাদ্দাম হোসেন। সংবর্ধিত অতিথির বক্তৃতা করেন, রামু উপজেলা যুবলীগ সভাপতি পলক বড়ুয়া আপ্পু ও কক্সবাজার পৌর যুবলীগ সভাপতি ডালিম বড়ুয়া। রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা ও জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জিৎময় বড়ুয়ার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন, উৎসব উদযাপন পরিষদের সমন্বয়ক অর্ক বড়ূয়া।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, প্রায় ২৫০ বছর আগে তৎকালীন ধনাঢ্য রাখাইন বৌদ্ধরা প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রাচীন রামুর বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসা উৎসব শুরু করেন। জাহাজ ভাসা উৎসবের প্রচলন হয় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে মুরহন ঘা নামক স্থানের একটি নদীতে। শতবছর ধরে প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধধর্মের অনুসারী রাখাইন ও বড়ুয়া সম্প্রদায় রামুর বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসা উৎসব আয়োজন করে আসছে। রামুর এ জাহাজ ভাসা উৎসব বৌদ্ধদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হলেও, কালক্রমে সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে সম্প্রীতির মহামিলন উৎসবে উদযাপিত হয়।