রুবেল বড়ুয়া:
বৌদ্ধরা নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করেন। এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো বিশেষ বিশেষ পূর্ণিমায় পালিত হয়ে থাকে।এ জন্য বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠাগুলোর সঙ্গে রয়েছে পূর্ণিমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।বুদ্ধের আদর্শ ও নৈতিকগুণাবলীকে স্মরণ করার জন্য এসব পূর্ণিমা উদযাপন করা হয়।
বৌদ্ধদের কয়েকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নাম হলো, বুদ্ধ পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, ফাল্গুনী পূর্ণিমা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তৎমধ্যে প্রবারণা পূর্ণিমা হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান।আশ্বিনী পূর্ণিমার অপর নাম হল প্রবারণা পূর্ণিমা।মূলত এ দিনেই ভিক্ষুগণ তিনমাস বর্ষাবাস ব্রত ভঙ্গ করেন।আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা – এ তিন মাস বৌদ্ধদের কাছে বর্ষাবাস বা ব্রত অধিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত ।
গৌতম বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে অনাথপিন্ড শ্রেষ্ঠীর আরামে অবস্থানকালে কৌশল জনপদে বর্ষাবাস যাপনকৃত ভিক্ষুসংঘের জীবনাচার বিধি অবগত হয়ে বুদ্ধ বর্ষাবাস তিনমাস বর্ষাবাসব্রত পালনোত্তর প্রবারণা পালনের সূচনা হয়। যা আজও যথাযথ শ্রদ্ধা,ধর্মীয় মর্য়াদায় ও
আন্তরিক অনুশীলনের মাধ্যমে ভিক্ষুসংঘের ধর্মাচারের ধারায় গুরুত্বের সাথে পালিত হচ্ছে।
প্রবারণাকে বৌদ্ধেরা বলে ‘বড় ছাদাং’। এর অর্থ বড় উপোসথ দিবস। উপোসথ হলো গৃহীদের চব্বিশ ঘণ্টার জন্য অষ্টশীল ব্রত পালন করা। এদিন সকালে বৌদ্ধ নরনারী শুচি শুভ্র হবে, পরিস্কার পোশাকে বৌদ্ধ বিহার সমবেত হয়, বুদ্ধকে পূজা দেয়, ভিক্ষুদের আহার্য দেয়, দান দেয়, অষ্টশীল ও পঞ্চশীল গ্রহণ করে, দুপুরে বিহারে বিহারে ভাবনা হয়, বিকেলে আয়োজিত হয় ধর্মসভা। এতে পন্ডিতজন অংশ নেন, বৌদ্ধধর্মের মূল বাণীগুলি সম্পর্কে আলোচনা হয়, রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এদিন ঘরে ঘরে ভাল রান্না হয়, অতিথিদের পায়েস পরিবেশন করা হয়।
প্রবারণার অর্থ :
প্রবারণার শাব্দিক অর্থ –প্রকৃষ্ট রূপে বারণ বা নিষেধকরণ।
সেই নিষেধযোগ্য বিষয় সমূহ হলো-আচরণীয় ক্ষেত্রে ত্রুটি নৈতিক স্থলন এবং সর্বোপরি চিত্তের মল (লোভ,বিদ্বেষ ও মোহ) এগুলোর নিরোধমূলক অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলে এগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়। প্রকৃত অর্থে এগুলোই হলো (লোভ,বিদ্বেষ ও মোহ) মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মূল অন্তরায়। এই অন্তরায় হতে দুরে থাকার জন্য চঞ্চল চিত্তের জন্য দরকার পরিশুদ্ধ অবলম্বন। তাই
‘প্রবারণার’ আর একটি অর্থ হলো ‘বরণ’ অর্থাৎ শুভ, শুদ্ধ, সুন্দর ও সু-আচারকে বরণ। বৌদ্ধ পরিভাষায় বলা যায়,অকুশলকে বারণ এবং কুশলকে বরণই হলো প্রবারণা। বলাবাহুল্য শুধু কৃতকর্মের জন্যই প্রবারণা নয়। গৌতম বুদ্ধের অনুজ্ঞা মতে চিত্তের অন্তলীন কমনা-বাসনা অথবা অনুমেয় ও আশন্কিত মনোবাসনার জন্যও প্রবারণা আবশ্যক।
এ দিন বৌদ্ধরা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি নানা কুশল কর্ম সম্পাদন করেন। শত্রু-মিত্র সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সকালে পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করেন।বিকালে আয়োজন থাকে নানাবিধ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি। বিশেষ করে জাহাজ ভাসানো উৎসব। নদীতে ভাসানো হয় হরেক রকমের প্যাগোডা আকৃতির জাহাজ । সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নানা রকমের বুদ্ধকীর্তন গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে । আবহমান বাংলার সংস্কৃতি , কৃষ্টিকে তুলে ধরে উৎসবের মধ্যে ।বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টলার কক্সবাজার ও রামুতে এ সব অনুষ্ঠান হয়।রামুর বাকঁখালী নদীতে জাহাজ ভাসানোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে বৌদ্ধদের বৃহৎ মিলনমেলা।এ যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক মিলন কেন্দ্র।
এ দিন সন্ধ্যায় হাজার প্রদ্বীপ প্রজ্জলন করা হয় বিহারে বিহারে। সন্ধ্যার আকাশ ফানুসের আলোতে দূর হয় অন্ধকারের কালো ছায়া।সম্প্রীতির জাহাজ ও ফানুসের আলোয় দূর হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক অন্ধকার।
সবাইকে শুভ প্রবারণার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।