প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু:
বুদ্ধের মতে প্রত্যেক বুদ্ধমাতা প্রথম সন্তান জন্মের এক সপ্তাহ পরে মৃত্যবরণ করেন। এবং মৃত্যু পরবর্তী তাবতিংস স্বর্গে অবস্থান করেন। একইভাবে গৌতম বুদ্ধের মাতা মহামায়া ও সিদ্ধার্থের (পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ) জন্মের এক সপ্তাহ পরে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাবতিংস স্বর্গে উৎপন্ন হন। কারণ বুদ্ধমাতার গর্ভে দ্বিতীয় সন্তান আসতে পারে না। এছাড়াও জগতে এক সাথে দুজন সম্যক সম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন না। একজন মাত্র সম্যক সম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন।
ভদ্রকল্পের পঞ্চবুদ্ধের মধ্যে বর্তমান চলছে চতুর্থতম বুদ্ধ গৌতম বুদ্ধের ধর্মশাসন। গৌতম বুদ্ধের শাসন বিলুপ্তির পরে ভদ্রকল্পের শেষ বুদ্ধ আর্যমৈত্রীয় বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন। এই সম্পর্কে গৌতম সম্যক সম্বুদ্ধ সবিস্থারে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বিমাতা গৌতমীর কাছে লালিত পালিত হন। এইজন্য তাঁকে গৌতম বুদ্ধ বলা হয়। ক্রমান্বয়ে তিনি ৩৫ বছর বয়সে সম্যক সম্বুদ্ধত্ব ফল লাভ করলেন। তিনি দিব্যজ্ঞানে মাতৃদেবীর অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হলেন। মাতাকে দুঃখমুক্তি দানের মানসে বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে গমন করলেন শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে। সেখানে তিনমাস অবধি অভিধর্ম পিটক (চিত্ত চৈতসিক সম্পর্কে বিশদ ব্যাখা) দেশনা করে মাতাকে মুক্তিমার্গ দান করেছিলেন। সাথে অসংখ্য দেব ব্রহ্মা ও ধর্মচক্ষু লাভ করেছিলেন। অতপর বর্ষাবাসের পরে তথাগত বুদ্ধ স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে অবতরণ করেছিলেন। সেদিন ছিল শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। আর সেটি ছিল বুদ্ধের জীবনের সপ্তম বর্ষাবাস।
মর্ত্যলোকে অবতরণের সময় ও এক অবিনাশী স্মৃতি সমৃদ্ধ ঘটনা ঘটে যায়। বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে বর্ষাবাস যাপনকালীন মাতৃদেবীকে উদ্দেশ্য করে ধর্মদেশনা করলেও পর সেই দেশনাবলি ছিল দেব উপযোগী। আগেই বলা গেছে যে, সেই দেশনায় অসংখ্য দেব ব্রহ্মা ধর্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। তখন দেব পরিষদ চিন্তা করলেন তারা কিভাবে বুদ্ধের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারেন।
বিশ্বকর্মা দেবপুত্র বুদ্ধের সম্মানে দৈব শক্তিতে তাবতিংস স্বর্গ থেকে ভারতের সাংকাশ্য নগর পর্যন্ত তিনটি স্বর্গীয় সিঁড়ি রচনা করলেন। মধ্যখানের সিঁড়ি ছিল মণিমুক্তা খচিত, বামপাশের সিঁড়ি ছিল রোপ্য খচিত এবং ডানপাশের সিঁড়ি ছিল স্বর্ণ খচিত। বুদ্ধ মাঝখানের সিঁড়ি দিয়ে দেবলোক হতে মর্ত্যলোকে অবতরণ করেছিলেন। ডানপাশের সিঁড়ি বেয়ে মহাব্রহ্মাসহ ব্রহ্মাগণ শ্বেতচ্ছত্র ধারণ করেছিলেন। বামপাশের সিঁড়ি বেয়ে দেবগণ বুদ্ধের প্রতি দিব্যপুষ্প বর্ষণ করতে করতে সাধু সাধু ধ্বনিতে আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত করে বুদ্ধের গুণকীর্তন করেছিলেন। সেদিন স্বর্গ-মর্ত্য একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ছিল এমন এক বিরল এবং দুর্লভ সময় সন্ধিক্ষণ যেই ক্ষণে দেবতা এবং মানুষ সরাসরি পরস্পরকে দর্শন করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। ভারতের সেই সাংকাশ্য নগরী এখনো পর্যন্ত বৌদ্ধদের জন্য পবিত্র তীর্থধাম হয়ে আছে।
ত্রিপিটকে উল্লেখ আছে যে, প্রত্যেক সম্যক সম্বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গ থেকে উক্ত সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করবেন। তাই এটিকে অপরিবর্তনীয় স্থান বলা হয়।
প্রবারণার অত্যুজ্জল স্মৃতি সমূহকে লালন করতে প্রবারণা উদযাপনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু প্রবারণার মূল শিক্ষাকেও আমাদের অন্তরে ধারণ করতে হবে।
সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা, রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপ, অনৈতিক কর্মকান্ড, হিংসা, হানাহানি, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ইত্যাদি বর্জনীয় দিকগুলোকে জীবন থেকে বাদ দিতে হবে। এসব পাপকর্ম থেকে সবসময় নিজেকে বারণ বা বিরত রাখতে হবে। সত্য, সুন্দর যা আত্ম ও পরকল্যাণকর, সুখপ্রদায়ী, শান্তিময় সেসব দিককে বরণ করতে হবে। এটাই প্রবারণার মূল শিক্ষা।
সবাইকে শুভ প্রবারণার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা।