সুনীল বড়ুয়া:
মাসব্যাপী নানা আনন্দায়োজন শেষে কাল সোমবার বাঁকখালী নদীতে আয়োজন করা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কল্পজাহাজ ভাসা উৎসব। শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রতিবছর এখানে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। কাল এ নদীতে ভাসবে রঙ-বেরঙয়ের দৃষ্টিনন্দন ছয়টি কল্পজাহাজ। এ উৎসবকে ঘিরে বাঁকখালী নদীর পাড়ে বসবে অসাম্প্রদায়িক এক মিলন মেলা।
এর আগে এ উৎসব আয়োজন অর্থ্যাৎ সেই কল্প জাহাজ তৈরীকে ঘিরে রামুর প্রায় বিশটি বৌদ্ধ পল্লীতে শেষ হয়েছে প্রায় একমাসের অন্যরকম আনন্দ আয়োজন।
‘শুকনো ডালে ফুল ফুটিল, স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এল, কে কে যাবি আয়রে; বুদ্ধের মত এমন দয়াল আর নাইরে’ এ রকম বুদ্ধ কীর্তন গেয়ে গ্রামের কিশোর ও যুবকেরা প্রতি রাতে এ বাড়ি থেকে ওই বাড়ি, এ পাড়া থেকে ওই পাড়ায় গিয়ে জাহার তৈরীর অর্থ সংগ্রহ করেন। এ সময় ঢোল, কাঁসর, মন্দিরা, বাঁশিসহ নানা বাদ্যবাজিয়ে নাচ গানেও মেতে ওঠেন তারা। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে পাড়ায় পাড়ায় এ আনন্দ যজ্ঞ শুরু হয়। প্রায় একমাস জাহাজ তৈরীর এ আনন্দায়োজন শেষে আজ সোমবার এতিহ্যবাহী জাহাজ ভাসা উৎসবে মেতে উঠবে বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা জানান, প্রতিবছর আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্নিমা পর্যন্ত তিনমাস বর্ষাব্রত পালনের শেষ দিনটি হচ্ছে, প্রবারণা পূর্ণিমা। এ দিনে ধর্মীয় নানা আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি শুধু মাত্র রামু উপজেলায় জাহাজ ভাসা উৎসবের আয়োজন করা হয়। তাই আষাঢ়ী পূর্ণিমার শুরু থেকে এখানে জাহাজ তৈরীকে ঘিরে এ আনন্দ যজ্ঞ চলে।
পূর্ব মেরংলোয়া গ্রামের কেতন বড়ুয়া জানান, গ্রামবাসীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে গ্রামের কিছু উৎসাহী যুবক জাহাজ তৈরীর উদ্যেগ নেন। বাঁশ, কাট, বেত, কাগজে রংয়ের কারুকাজ করে দৃষ্টিনন্দন কল্পজাহাজ তৈরী করতে অভিজ্ঞ কারিগরেরা এসব জাহাজ তৈরী করেন। এ বছরও জাহাজে ময়ূর, কবুতর, হাঁস, উড়োজাহাজসহ, বিভিন্ন প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।
জাহাজ ভাসা উদযাপন কমিটির সভাপতি পলক বড়ুয়া আপ্পু জানান, এ বছর ১৬ ও ১৭ অক্টোবর দুইদিন রামুতে প্রবারণা উদযাপন করা হচ্ছে। কাল বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপনের মধ্যদিয়ে দু’দিনের উৎসব শেষ হবে। হাইটুপী, মেরংলোয়া, পূর্বমেরংলোয়া, হাজারীকুল, পূর্বরাজারকুল, এবং আদিবাসী সম্প্রদায় রাখাইন জনগোষ্ঠীসহ মোট ছয়টি দৃষ্টিনন্দন কল্প জাহাজ এ বছর ভাসানো হবে।
রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষেদের আহবায়ক রজত বড়ুয়া রিকু জানান, প্রতি বছরই জাহাজ ভাসা উৎসবকে ঘিরে বাঁকখালী নদীতে অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলা বসে। হাজারো নরনারীর অংশগ্রহনে মুখরিত হয়ে ওঠে নদীর দ’পাড়। আশা করছি,আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে এ বছর লোক সমাগম আরো বেশি হবে।
বাংলাদেশী বৌদ্ধদের উপ-সংঘরাজ ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের জানান, জাহাজ ভাসার ধর্মীয় গুরুত্ব তো আছেই,এ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এ উৎসবের প্রচলন হয়। প্রায় শত বছর ধরে,রামুতে এ উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে।
এদিকে কাল সোমবার বেলা আড়াইটায় জাহাজভাসা উৎসবের উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ ভিক্ষু মহাসভার উপ সংঘরাজ,রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি।
এছাড়াও জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন,পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ,রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম,সিভিল সার্জন ডা. পুচনু,ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.নিকারুজ্জামান, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভুষন বড়ুয়া, রামু থানার অফিসার ইনচার্জ প্রভাষ চন্দ্র ধর,জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা,ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম, রামু উপজেলা বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদের সভাপতি প্রবীর বড়ুয়া,সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া, ও রামু উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।