আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় থাকতাম। আমার উপত্যকা, সোয়াত উপত্যকা হলো পর্বতের স্বর্গরাজ্য, যেখানে আছে স্ফটিক-স্বচ্ছ হ্রদ এবং প্রবল গতিতে ছুটে চলা জলপ্রপাত। উপত্যকায় ঢুকতেই চোখে পড়বে ফলকে লেখা, ‘স্বর্গে স্বাগতম’। আগেকার দিনে সোয়াতকে বলা হতো ‘উদ্যান’। আমাদের বুনোফুলে ভর্তি মাঠ আছে, রসাল ফলের বাগান আছে, পান্নার খনি আর টাকি মাছে ভর্তি নদী আছে।
সোয়াতকে বলা হয় পুবের সুইজারল্যান্ড– পাকিস্তানের প্রথম স্কি রিজোর্টও আমাদেরই। পাকিস্তানের বড়লোকেরা ছুটিতে আমাদের বিশুদ্ধ বায়ু সেবন ও প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে আসে, উপভোগ করে নাচে-গানে ভরপুর সুফি উৎসব। আসত বিদেশিরাও এবং তারা যেখান থেকেই আসুক না কেন, আমরা তাদের বলতাম ‘আংরেজান’ বা ইংরেজ। এখানে ইংল্যান্ডের রানিও এসেছেন এবং সোয়াতের প্রথম ওয়ালির স্থাপিত ‘হোয়াইট প্যালেস’-এ থেকেছেন, যেটি তাজমহলের মতোই একই ধরনের মর্মর পাথরে তৈরি।
আমাদের বিশেষ ইতিহাসও আছে। আজ সোয়াত হলো খাইবার পখতুনখোয়া, বা, কেপিকে প্রদেশের অংশ কিন্তু আগে সোয়াত পাকিস্তানের বাকি অংশ থেকে আলাদা ছিল। আমরা আগে রাজকীয় অবস্থায় ছিলাম, চিত্রল এবং দির-এর তিন প্রতিবেশীর একটি। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় আমাদের রাজারা ব্রিটিশদের অনুগত ছিলেন কিন্তু নিজেদের এলাকা নিজেরাই শাসন করতেন। ব্রিটিশরা যখন ১৯৪৭-এ ভারতকে স্বাধীন করে ভাগ করে দিয়ে গেল, আমরা নবজাতক পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলাম কিন্তু স্বায়ত্তশাসিতই থাকলাম। আমরা পাকিস্তানি রুপি ব্যবহার করতাম তবে পাকিস্তান সরকার কেবল পররাষ্ট্রনীতিতেই হস্তক্ষেপ করতে পারত। ওয়ালি বিচার প্রতিষ্ঠা করতেন, যুদ্ধরত গোত্রের মাঝে শান্তি রক্ষা করতেন এবং আয়ের ১০ শতাংশ কর ‘উশোর’ আদায় করতেন, যা দিয়ে রাস্তা, হাসপাতাল ও স্কুল নির্মাণ করা হতো।
আমরা থাকতাম মিঙ্গোরায়, যেটা উপত্যকার সবচেয়ে বড় শহর, সত্যিকার অর্থে একমাত্র শহর। এটা একটা ছোট জায়গা ছিল, কিন্তু আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোক এসে এখানে থাকা শুরু করলে জায়গাটা জনবহুল এবং নোংরা হয়ে যায়। আমাদের হোটেল, কলেজ, একটি গলফ কোর্স এবং একটি নামকরা বাজার ছিল, যেখানে ঐতিহ্যবাহী সূচিশিল্প, দামি পাথর ও প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনতে পাওয়া যেত। মারঘাজার জলপ্রপাতটা বাজারের ভেতর দিয়ে গেছে, ওর ভেতর ফেলা ময়লা আর প্লাস্টিক ব্যাগের কারণে পানিটা ঘোলাটে বাদামি হয়ে গেছে। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো এটা অতটা স্বচ্ছ নয়, বৃহত্তর সোয়াত নদীর মতো পরিষ্কারও না। শহরের ঠিক বাইরে সোয়াত নদীতে মানুষ টাকি মাছ ধরত, যেখানে আমরা বেড়াতে যেতাম। আমাদের বাসা ছিল গুলকারা, যার অর্থ ফুলের স্থান, কিন্তু আগে একে বলা হতো বাটকরা বা বৌদ্ধমূর্তির জায়গা। আমাদের বাসার কাছে ছিল রহস্যময় ধ্বংসাবশেষ ছড়ানো এক মাঠ—বসে থাকা সিংহের মূর্তি, ভাঙা খুঁটি, মস্তকবিহীন মূর্তি আর সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার—শত শত পাথরের ছাতা।
আমাদের উপত্যকায় ইসলাম এসেছিল একাদশ শতকে, যখন গজনির সুলতান মাহমুদ আফগানিস্তান থেকে এসে আমাদের শাসক হয়ে বসলেন। কিন্তু প্রাচীনকালে সোয়াত ছিল বৌদ্ধদের রাজ্য। বৌদ্ধরা দ্বিতীয় শতকে এখানে এসে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছিল। চীনা পর্যটকদের গল্পে ফুটে ওঠে, সোয়াত নদীর তীরে এক হাজার ৪০০টি মঠ ছিল এবং কীভাবে বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টার জাদুময়ী শব্দ উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ত। মন্দিরগুলো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু তুমি সোয়াতের যেখানেই যাবে, সেখানেই বাসন্তীকুসুম এবং অন্যান্য বুনো ফুলের মাঝে তাদের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা পদ্মাসনে বসে থাকা হাস্যোজ্জ্বল ভগবান বুদ্ধের প্রস্তরমূর্তির আশপাশে প্রায়ই বনভোজনে যেতাম। প্রচলিত আছে, ভগবান বুদ্ধ নিজে এ শান্তিময় জায়গায় এসেছিলেন এবং এই উপত্যকায় একটি বিশালিকৃতি স্তূপার নিচে তাঁর ভস্মের কিছু অংশ পোঁতা আছে বলেও জনশ্রুতি আছে।
বাটকরার ধ্বংসাবশেষ ছিল লুকোচুরি খেলার এক জাদুকরি স্থান। একসময় কতিপয় বিদেশি প্রত্নতাত্ত্বিক এখানে কাজ করতে এসে বলেছিলেন, অতীতে এটি ছিল বৌদ্ধ রাজাদের কবর এবং স্বর্ণের গম্বুজসংবলিত বুদ্ধমূর্তিতে উদ্ভাসিত এক তীর্থস্থান। আমার বাবা ‘বাটকরার পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন, যেখানে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল মসজিদ ও মন্দির কীভাবে পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে-
মিনারে যখন সত্যের ভাষণ জাগে
বুদ্ধ তখন হাসেন
এবং ছেদ পড়া ইতিহাস জোড়া লাগে।
আমি মালালা বলছি
মূলঃ মালালা ইউসুফজাই
সহলেক্ষকঃ ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব
অনুবাদঃ রোজা শাওয়াল রিজওয়ান
(সংগৃহিত)