সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ১৯৮৮ সালের বিধিতেই লেখা আছে, রায় দিতে হবে প্রকাশ্য আদালতে, যার ফলে অবসরের পর রায় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিধি অনুযায়ী রিভিউ ছাড়া আদালতে ঘোষিত রায়ের কোনো পরিবর্তন, সংযোজন করা যাবে না। অবশ্য ঘোষিত রায়ের অনুলিপি দেওয়ার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই।
তবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেছেন, বিধিতে বর্ণিত ‘রায়’ বলা মানে কারণসংবলিত ‘পূর্ণাঙ্গ রায়’ নয়। রায়ের সংক্ষিপ্ত কার্যকর অংশকে বোঝানো হয়েছে। অবশ্য আপিল বিভাগে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার প্রথা চললেও হাইকোর্টে চলেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ১৯৮৮ সালের বিধিতে ‘রায়’ মানে কার্যকর (অপারেটিভ) অংশ নয়, এটা ‘পূর্ণাঙ্গ রায়’ বুঝতে হবে। তিনি আরও বলেন, ইদানীং হাইকোর্টেও প্রকাশ্য আদালতে পূর্ণাঙ্গ রায় না দিয়ে ‘সংক্ষিপ্ত রায়ের’ প্রচলন শুরু হয়েছে। বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে, অথচ পূর্ণাঙ্গ রায় মিলছে না। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ‘বাস্তব কারণেই দীর্ঘ রায়ের বিবরণ পড়ে সময় নষ্ট না করে কার্যকর অংশ পড়া হয়।’
অবসরে গিয়ে রায় লেখা নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে তুমুল বিতর্ক চলছে। আর এ বিতর্ক শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার আপিল বিভাগের রায় ১৬ মাস বিলম্বে প্রকাশের ঘটনায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেওয়া হয়েছিল ২০১১ সালের ১০ মে। সম্প্রতি আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ১৬৯টি মামলার রায় ও আদেশ বাকি রেখে অবসরে যান। গত মাসে প্রধান বিচারপতি তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরপূর্তিতে দেওয়া এক বাণীতে অবসরে গিয়ে রায় প্রদানকে ‘সংবিধান পরিপন্থী’ বলে মত দেন। এরপরই এ বিষয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাছাকাছি সময়ে প্রধান বিচারপতিসহ তিন বিচারপতির অবসরে যাওয়ার কারণে অন্তত ৩০৬টি মামলার রায় ও আদেশ বাকি পড়ে ছিল। এটা নতুন রেকর্ড, যার কোনো পূর্ব নজির নেই।
অথচ প্রচলিত কোনো আইন বা ভিন্ন দেশের নজির অবসরে রায় লেখা সমর্থন করে না। কিন্তু বাংলাদেশে এটা রেওয়াজ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতসহ বেশির ভাগ দেশে বহু মামলায় সংশ্লিষ্ট সব বিচারকের সই হওয়ার পরে লিখিত রায়ের কার্যকর অংশ প্রকাশ্য আদালতে পড়া হয়। এতেও স্পষ্ট যে অবসরে কোনো রায় হয় না। আবার জরুরি বিষয় হলে শুধু আদেশ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য আলাদা দিন ধার্য করা হয়। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের হাইকোর্ট রুলসেও এই বিধান আছে।
দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (আপিল বিভাগ) রুলস, ১৯৮৮-এর অর্ডার ১০-এর বিধিতে বলা আছে, ‘আদালত মামলার শুনানি শেষ করার পরে তাৎক্ষণিকভাবে কিংবা ভবিষ্যৎ কোনো দিনে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে বা তাদের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডকে নোটিশ দিয়ে রায় ঘোষণা করবেন। আপিল বিভাগের রুলসের আদেশ নম্বর ২৬ মেনে চলা (রিভিউ করা) সাপেক্ষেই কেবল রায়ের নড়চড় হতে পারে। এই উপায় ছাড়া রায় প্রদানকারী আদালত বা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক বা কোনো ভিন্নমত প্রদানকারী বিচারক তাঁদের দ্বারা ঘোষিত রায়ের কোনো পরিবর্তন বা সংযোজন করতে পারবেন না। শুধু করণিক বা গাণিতিক ভুল বা দুর্ঘটনাক্রমে কোনো ত্রুটি বা বিচ্যুতি ঘটলে তার সংশোধন করা যাবে। আর যথানিয়মে আদালত এসব রায়ের জাবেদা (সার্টিফায়েড) কপি সরবরাহ করবেন।’ কিন্তু ‘যথানিয়মে’ অনুলিপি সরবরাহের কোনো সময়সীমা নেই।
১৯৮৮ সালের ওই রুলস প্রথম ১৯৭৩ সালে প্রণীত হয়। ২০০৮ সালের ২২ এপ্রিল সর্বশেষ সংশোধনী আসে। সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেওয়ার পরই নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে তিন সদস্যের একটি রুলস কমিটি করেছেন। এই কমিটি এখন আপিল বিভাগের রুলস হালনাগাদ কাজে নিয়োজিত আছে। আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ভবিষ্যতের জন্য রুলসে উপযুক্ত সংশোধনী আনাই সমীচীন। সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে কোনো আদালতের রীতি ও পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণে বিধি তৈরিতে সুপ্রিম কোর্টকে এখতিয়ার দেওয়া আছে।
রায় কী বা কখন, কীভাবে লেখা হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রিটিশ আমলের ১৯০৮ সালের দ্য কোড অব সিভিল প্রসিডিউর (সিপিসি)। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান একই সিপিসিতে চলছে। সিপিসির ২(৯) বিধিতে বলা আছে, ‘রায় মানে বিচারক যে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন তার কারণসংবলিত ব্যাখ্যা।’ সিপিসির আদেশ ৮-এর বিধি ১০ বলেছে, আদালতকে রায় দিতে সিপিসির বিধানাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্য বা অন্তত যে বিতর্কের সুরাহা হলো, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একাধিক রায়ে বলেছেন, রায় প্রদানে সিপিসির বিধানাবলি মানতেই হবে। মামলার রায়ে কারণ দেখানোই রায়ের আত্মা। ১৯৯৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বলরাজ তানিজা বনাম সুনীল মদন মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, রায় মানে উপযুক্ত কারণ ও ব্যাখ্যাসংবলিত রায়। প্রকাশ্য আদালতে ‘স্যুট ডিক্রিড’ বা ‘স্যুট ডিসমিসড’ বলে রায় দেওয়া চলবে না।
বাংলাদেশের অধস্তন আদালতের বিচারকেরা দ্রুত পূর্ণাঙ্গ রায় দেন। না দিলে তাঁরা হাইকোর্ট দ্বারা তিরস্কৃত এমনকি শাস্তিপ্রাপ্ত হন।
আদালত প্রশাসন সূত্র জানায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ২৫টি মামলা রেখে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অবসরে যান। এরপর ১৬টির রায় জমা দিয়েছেন। এখন তাঁর কাছে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের মামলাসহ নয়টি মামলার রায় বাকি আছে। এ বিষয়ে অবশ্য চেষ্টা করেও তাঁর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ১৬৯টি রায় বাকি রেখে গত অক্টোবরে অবসরে যান। তিনি ৮ ফেব্রুয়ারি ৬৫টি মামলার রায় ও নথি জমা দিয়েছেন বলে দাবি করেন। এখন তাঁর কাছে ২২টি মামলার রায় বাকি আছে বলে উক্ত সূত্রের দাবি। বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার গত ১৯ জানুয়ারি অবসরে গেছেন। গত ২৭ জানুয়ারি ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর কাছে স্বীকার করেন, তিনি অবসরে গিয়ে দুই দিনে ৩০০ আদেশে সই করেছেন। গত বুধবার আদালত সূত্র বলেছে, তাঁর কাছে ১১২টি মামলার রায় বাকি আছে। তবে অধিকাংশের টাইপ শেষ, সইয়ের অপেক্ষায় আছে।
আদালতের প্রশাসন সূত্র বলেছে, বিদ্যমান হাইকোর্ট বেঞ্চগুলোতে কী ধরনের কত মামলার রায় বাকি, তা বলার মতো কোনো সমন্বিত তথ্যপ্রবাহ সুপ্রিম কোর্টের নেই। এটা তৈরির উদ্যোগ আছে। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তথ্য সরবরাহ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
এ ছাড়া আরও জানা যায়, বিলম্বে পূর্ণাঙ্গ রায় দিলেও রেকর্ডে ভূতাপেক্ষভাবে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায়ের তারিখ ব্যবহার করা হয়। এটাই রেওয়াজ হিসেবে চলছে। সংবিধানমতে, সুপ্রিম কোর্ট একটি কোর্ট অব রেকর্ড। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রস্তুত ও সই করার প্রকৃত রেকর্ড জনগণ জানতে পারে না।
‘প্রকাশ্য আদালতে’ রায়দানসংক্রান্ত কোনো বিধান ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশ হাইকোর্ট রুলসে নেই। তবে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল একমত যে যেখানে রুলস নীরব, সেখানে ১৯০৮ সালের সিপিসির বিধান চলবে। সিপিসি একটি আইন। এর শক্তি বিধির চেয়ে বেশি। আর সিপিসিতে আপিল বিভাগের মতোই প্রকাশ্য আদালতে ‘রায় ঘোষণার’ বিধান আছে।
বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বর্তমানে হাইকোর্টে এক থেকে দেড় শ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা বাকি আছে।’ কিন্তু বাস্তবে এর সংখ্যা আরও অনেক বেশি মনে করা হয়। আদালতের কর্মকর্তারা বলেছেন, বেশ কিছু রায় ইতিমধ্যে জমা পড়েছে। প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নিয়েই দ্রুত পূর্ণাঙ্গ রায় শেষ করার তাগিদ দিয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা তৈরি করেছেন। অস্ট্রেলিয়া ১৯৯২ সালে ফরম্যাটও করে দিয়েছে। শুনানি শেষের পরে রায় ঘোষণার মধ্যে দীর্ঘসূত্রতা বহু দেশের উচ্চ আদালতে আছে। এমনটা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন্দ্র পাল বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের পর সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তারা অবসরে রায় লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে এই বাঙালি বিচারপতি বলেন, ‘এ রকম রেওয়াজ ভারতে নেই।’
অভিজ্ঞ আইনবিদেরা বলেন, পাকিস্তান আমলেও অবসরে গিয়ে রায় দেওয়ার তেমন নজির ছিল না। হাইকোর্ট সব সময় পূর্ণাঙ্গ রায়ের ডিকটেশন প্রকাশ্য আদালতে দিয়েছেন। যেমন ২০০৫ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকে বৈধতাদানকারী পঞ্চম সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের ৩৯১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় আদালতে পাঠ করেছিলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, হাইকোর্টে পূর্ণাঙ্গ এবং আপিল বিভাগে সংক্ষিপ্ত রায় বা আদেশ ঘোষণা করার রেওয়াজ চলে আসছে। তিনি বলেন, তবে সাম্প্রতিক কালে হাইকোর্টের কিছু বেঞ্চ আপিল বিভাগের মতো মামলার রায়ের কার্যকর অংশ ঘোষণা দিচ্ছেন। এবং সেখানে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পেতে উদ্বেগজনক বিলম্ব ঘটছে।
ঘোষিত রায় পরিবর্তন বিষয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নাম উল্লেখ না করে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী ওই সেমিনারে বলেছিলেন, ১৬ মাস পরে দেওয়া মূল রায় পাল্টানো ফৌজদারি অপরাধ। ধারণা করা হয়, তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের প্রতি ইঙ্গিত করে এই মন্তব্য করেন। ওই মামলায় ভিন্নমত প্রদান করে রায়দানকারী হলেন বর্তমান আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। তিনি তাঁর রায়ে বলেন, ‘২০১১ সালের ১০ মে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত শর্ট অর্ডারকে প্রধান বিচারপতির বর্তমানের রায় সমর্থন করে না। তিনি (বিচারপতি খায়রুল) সংযোজন করেছেন।’ বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাও তাঁর রায়ে শর্ট অর্ডার পরিবর্তন করার দাবিটি সমর্থন করেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরীর রায় পাল্টানোর মন্তব্য সম্পর্কে বক্তব্য চাওয়া হলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তিনি রায় পরিবর্তনের দাবির সঙ্গে একমত নন। কারণ, বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে সংক্ষিপ্ত রায় যুক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, রায় প্রদানের পরে তা পরিবর্তন করার বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া ২০০২ সালের একটি রায় আছে। শ্রী শান্তি ভূষণ দেব বনাম অন্যান্য মামলাটির রায়দানকালে প্রধান বিচারপতি ছিলেন মাহমুদূল আমীন চৌধুরী। তাঁর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ বলেছেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে আদালতের মূল সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং তা সই হওয়ার পরে আর পাল্টানো যাবে না। তবে ঘোষণার পরে যদি আদালত মত পাল্টাতে চান, তাহলেও সেটা পারবেন। সেটা করতে হলে ঘোষিত রায় বা আদেশ লিখিতভাবে তলব করতে হবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে পুনরায় শুনতে হবে।’
ঢাকা ল রিপোর্টস (ডিএলআর) সম্পাদক খুরশীদ আলম খান অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি এসে অনেক মামলায় দুই পক্ষের শুনানির বরাতে পূর্ণাঙ্গ আদেশ (সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যাসংবলিত) দিচ্ছেন, যার জাবেদা অনুলিপিও অনধিক এক সপ্তাহের মধ্যে মিলছে, এটা আগে ছিল না।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ের ভিত্তিতে ওই শান্তি ভূষণ বনাম অন্যান্য মামলার রায় লিখেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম। এখন বিতর্ক দেখা দিয়েছে বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার ‘মূল রায়’ পরিবর্তন করেছিলেন কি না।
বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী অবশ্য অবসরে গিয়ে ‘মাত্র কয়েক মাস’ বিলম্বে রায় লেখাকে বৈধ বলে মত দেন। তবে আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলেন, প্রচলিত আইনে এর কোনো সমর্থন নেই। অবসরে গিয়ে রায় লেখার বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে দেওয়া পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায় কখনো বাংলাদেশে উল্টে যায়নি। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির এক আদেশের মাধ্যমে পাকিস্তানের সব প্রচলিত আইনকে গ্রহণ করা হয়েছে। আর সুপ্রিম কোর্টের রায় আইন হিসেবে গণ্য হয়।
১৯৬৪ সালে একজন বিচারক অবসরে গিয়ে মন্ত্রী (ভাওয়ালপুর এস্টেটের) হয়ে রায়ে সই করেছিলেন। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ তাকে বেআইনি বলেছিলেন। রায়ে বলা হয়েছিল, অবসরে গিয়ে যেকোনো প্রকারের বিচারিক কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা বৈধ নয়।
ভারতের প্রধান বিচারপতিরা অবসরে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার পরিবর্তে বরং দ্রুততার সঙ্গে সংক্ষেপে রায় প্রদানের শক্তিশালী রেওয়াজ গড়ে তুলেছেন। ২০১৩ সালের এক রায়ে বিচারপতি এ আর দেব বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন, তাই “দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত” রায় লিখলাম।’ ১৯৭৩ সালের কেশবানন্দ ভারতি মামলার রায়দানকালেও প্রধান বিচারপতি এস এম সিকরি অবসরে যাবেন বলে তাড়াহুড়ো ঘটে। প্রধান বিচারপতি মামলার ১৩ বিচারককে নিয়ে একটি বৈঠক করারও সময় পাননি। ১৯৮০ সালে বিখ্যাত বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার অবসরে যাবেন। তিনি লিখলেন, ‘আমার অবসর সন্নিকটে, তাই রায়টা দ্রুত শেষ করতে হলো।’
দেশ-বিদেশের আইন, রেওয়াজ ও নজিরের পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, রায়ের ঘোষণা কখনো সংক্ষিপ্ত হতে পারে। কিন্তু কোনোক্রমেই অবসরে রায় লেখা যাবে না। রায় সইয়ের পরে কোনো বিচারক মারা গেলেও তাঁর রায় টিকবে। তাঁর উত্তরসূরি সেটা ঘোষণা দেবেন। কিন্তু সই না দিয়ে প্রস্তুত করা কোনো রায় বিচারকের মৃত্যুতে টিকবে না। নতুন করে শুনানি গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং অবসরে রায় লেখার কোনো ভিত্তি নেই।
কৃতজ্ঞতাঃ প্রথম আলো