সৈকত মিত্র বড়ুয়া:
মেয়ে হয়ে জন্মানোটা আজন্ম পাপের, হাসতে গেলেও ভাবতে হয়, আবার কান্না করতে গেলেও ভাবতে হয়।বিয়ের আগে বা পরে আমাদের দেশে ছেলে পক্ষের লোকজন যা বলে থাকে, ছেলে পক্ষ- আরে না না, কি যে বলেন, বেয়াই সাব.. আমাদের ছেলেকে কিছুই দিতে হবে না, শুধু মাত্র আপনার মেয়েকে দিন, আমাদের আর কিছুই লাগবে না। তবে বরযাত্রী হিসেবে ৬০০ জন, আর ক্লাবটা সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেই হয়! এমনকি খাবারের আইটেম হইতে শুরু করে সব সিদ্ধান্ত নিবে ছেলে পক্ষ, এখানে মেয়ে পক্ষের কোন সিদ্ধান্তের দাম নাই, কারণ তারা অপরাধী, তাদের একমাত্র অপরাধ তারা মেয়ে সন্তানের জনক।
পরিবারে একটা ছেলে সন্তান জন্ম নিলে আমরা যে পরিমাণ খুশি হই, ঠিক তেমনি মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে আমরা সমান তালে খুশি হই। একটা দম্পতির ঘরে পর পর ছেলে হলে সবাই খুশি হয়, কিন্তু পর পর যদি মেয়ে জন্ম নেয় সব দোষ বউয়ের, তাই যতক্ষণ পর্যন্ত ছেলে হচ্ছে না ততক্ষণ বউকে গর্ভ ধারণ করতেই হবে ! আমার দেখা এ রকম কয়েকটা পরিবার নিজে দেখেছি পর পর ৫ টা মেয়ে হওয়ার পরেও তাদের একটা ছেলে দরকার ছিল বংশ রক্ষা করার জন্য। সেখানে বউ বাঁচুক কিংবা না বাঁচুক স্বামীর কিছুই আসে যায় না!
আমাদের সমাজে যৌতুক প্রথা অনেকটা কমে আসলেও, তারপরেও মেয়ে পক্ষ তাদের সাধ্যমতো ছেলে পক্ষকে উপহার নাম সরূপ যৌতুক প্রদান করে। বড়লোক যৌতুক দিলে সেটা হয় উপহার, আর মধ্যবিত্ত পরিবার উপহার দিলে সেটা হয় যৌতুক! এক সময় তো যৌতুক সরাসরি চাওয়া হত, এখন তেমনটা দেখা যায় না, কিন্তু উপহার সরূপ যৌতুক প্রথা এখনো চালু আছে। এই যেমন বরযাত্রী ৬০০ জন খাওয়াতে হবে! ক্লাবটা সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে হবে! খাবারে থাকতে হবে মুখরোচক খাবার! আইটেম হতেই শুরু করে সব কিছুর সিদ্ধান্ত নিবে ছেলে পক্ষ, এখানে মেয়ে পক্ষ অসহায়! কারণ তারা মেয়ের পরিবার।
আমাদের সমাজে মেয়ে হয়ে জন্ম গ্রহন করা মানেই পরিবারের বোঝা। কখন মেয়ে বড় হবে, তাকে বিয়ে দিতে হবে ছোট বেলা হতে তাকে তাই শেখানো হয়। বলা হয়, এটা তোর আসল বাড়ি নয়, শশুর বাড়ি হল তোর আসল ঠিকানা। তাই অনেক মেয়েকে হতাশার সুরে বলতে শুনেছি, মেয়ে হয়ে জন্মানোটা আজন্ম পাপ!
বিয়ে তো হয়ে গেল, এবার মেয়েকে যদি ভারি কিছু দিয়ে বিদায় না করে, মা-বাবার মনে দুশ্চিন্তায় গ্রাস করে, মেয়ে শশুর বাড়িতে গিয়ে আদৌ সুখে থাকতে পারবে কিনা! মেয়ের ও সব সময় ভয় থাকে, শশুর বাড়ির লোকজন দেওয়া না দেওয়া নিয়ে কোন বলে কিনা! আমি মনে করি আজকালকার যুগে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করার চাইতে প্রেম-ভালবাসা করে বিয়ে করাটা শ্রেয় মনে করি, কারণ প্রেম-ভালবাসা করে বিয়ে করলে একে অপরকে জানতে পারে, বুঝতে পারে, দীর্ঘদিন প্রেম করে বিয়ে করলে তারা একে অপরকে বুঝার সময়টা যতেষ্ট পরিমাণে পেয়ে থাকে। কিন্তু পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলে তাদের বুঝাপড়া, তাদের মন মিলন হতে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হয়। মেয়েটার কাছে সব কিছুই নতুন মনে হয়, যেমনটা নতুন মানুষ, নতুন পরিবার, নতুন জায়গা সব কিছু গুছিয়ে নিতে মেয়েটার অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়।
তাইতো আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক প্রেম নিয়ে বলেছেন- “প্রেম করে বিয়ে করলে নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে করতে হয়, আর পরিবারের পছন্দ মত বিয়ে করলে অন্যের প্রেমিকাকে বিয়ে করতে হয়”। — হুমায়ূন আহমেদ–
স্বাভাবিক যাদের অর্থ আছে তারা চাইলেই মানবিক সেবা করতে পারে। আর বিয়ে বলে যেহেতু কথা, তাই যৌতুক প্রথাকে বাদ দিই কি করে! যৌতুক হিসাবে, টিভি, ফ্রিজ, মোটর সাইকেল, নগদ টাকা, ফার্নিচার, এগুলাতো প্রকাশ্যে নেওয়া হয়। তবে লোক চক্ষুর আড়ালে যে ৫০০/১০০০ বরযাত্রী, ক্লাব ভাড়া, খাবারের খরচ, এবং বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে খাবার পাঠানো ইত্যাতি ইত্যাদি, এগুলা কি যৌতুকের মাঝে পড়ে না ? একটা পরিবারে যদি ৪ টা মেয়ে থাকে, একটার পিছনে যদি ১০/১৫ লাখ টাকা খরচ করা হয়, তাহলে ঐ পরিবারটি নিঃস্ব হবে না ? দায় দেনা করে কি মেয়ে বিয়ে দিবে না ? আর এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা কি একক ভাবে অবিচার, অত্যাচার নয় কি! আর প্রেমের ক্ষেত্রে যেটা বলেছি, প্রেম করে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করতে বলেছি, পালিয়ে নয়। হয়তো লিখতে গেলে লিখা অনেক বড় হয়, পাঠকের পড়তে অসুবিধা হয়, তাই স্বল্প পরিসরে লিখা। তবে আমি কি বলতে চাই, সেটাও পাঠককে বুঝে নিতে হবে।
তবে এ ব্যপারে ছেলে পক্ষকে শতভাগ এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু সমাজে রীতিনীতি চলে আসতেছে যুগ যুগ ধরে, সেটা আপনি , আমি একদিনে বদলাতে পারব না, কিন্তু আবার চাইলেই পারি হ্যাঁ ছেলে পক্ষ যদি আন্তরিক হয় তার হবু শ্বশুর বাড়ির জন্য! যদি মানবিক দিকটা চিন্তা করে! যদি শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে নিজের মা-বাবার মত করে ভাবে! যদি নিজের পরিবারের মত করে ঐ পরিবারটির কথাও চিন্তা করে তাহলেই সম্ভব। আমি আগেও বলেছি, সমান সমান করে উভয় পক্ষ চাইলেই পারে। এজন্য দরকার সৎ সাহস সাথে মানবিকতা এবং সেটা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে ছেলের পরিবার হতে।
তার জন্য চাই পরস্পর সহযোগিতার সঙ্গে আন্তরিকতা। তবে এক্ষেত্রে রীতিনীতি যেহেতু আমাদের বহুকাল আগে হতে প্রচলিত ছিল যে মেয়েপক্ষকে সব খরচ বহন করতে হবে, এখন আমরা ছেলেপক্ষ যদি আন্তরিক হই তাহলে এ প্রথা চিরতরে সমাপ্ত হবে। এবং বিয়ের পর যাতে নব বধুকে এই সব নিয়ে কোন কথা শুনতে না হয়, সেটাও হবু জামাইকে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই সুন্দর হবে সংসার অভিশপ্ত যৌতুক প্রথা হতে বাঁচবে মেয়ের পরিবার। এই অভিশপ্ত যৌতুক প্রথার কারণে কোন পরিবার আর কখনো, কোনদিন নিঃস্ব হবে না। দেনার দায়ে কোন পিতাকে গালি শুনতে হবে না, মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় আত্বীয়-স্বজনদের কাছে হাত পাততে হবে না। নিজের মেয়ের বিয়ে, নিজের মত করে দিতে পারবেন পরিবার।
সুতরাং, দিন বদলাচ্ছে, আর বদলাচ্ছে সমাজ, শুধু মাত্র বদলাতে পারতেছি না আমরা। বিয়ে একটা সামাজিক প্রথা, তা হলে আমরা শুধু মাত্র মেয়ের পরিবারকে কেন চাপ সৃষ্টি করব! খরচটা যদি করতেই হয়, তাহলে সমানে সমানে করুন! কারণ একটা পরিবারে যদি ৪ টা মেয়ে থাকে, তাহলে এই চারটা মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে আপনার হবু শশুর মশাই নিঃশ্ব হয়ে যাবে। যদি মেয়ের পরিবার নিজে হতে কিছু দিতে চাই তো নিতে আপত্তি নাই। কিন্তু ভদ্র লোকের
মুখোশের আড়াল হতে ভয়ানক যৌতুক প্রথা হতে বের হয়ে আসুন।
আমাদের সমাজে এ রকম অনেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকে, কবে বিয়ে করবে, কবে শশুর বাড়ি হতে টাকা দিবে! কবে শশুর তারে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করাবে, কবে টিভিতে রঙ্গিন ছবি দেখাবে, কবে একটা মোটর সাইকেল দিবে! মেয়েতো নয়, যেন টাকার গাছ আনতেছে ছেলে বাড়িতে। অনেকটা দুগ্ধবতী গাভীর মত। দোহন করে খাবে সারাটা জীবন!
তাই আসুন এমন নিষ্টুরতম প্রথা হতে বের হয়ে আসি। বদলে দেওয়ার চেষ্টা করি। নিজে বদলান, দেখবেন আপনার দেখাতে হাজার জন বদলাবে। আলো আসবেই, আজ না হয় কাল, আসতেই হবে।