প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু:
বুদ্ধমূর্তি কোথা থেকে এল আর কোথায় যাচ্ছে ?
রাঙ্গামাটি জেলার চনদ্রঘোনা থানার মৈত্রীপাড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত উ নাগিন্দা মহাথেরকে টেকনাফের এক দায়ক বিহারে পূজা বন্দনা করার জন্য বুদ্ধমূর্তিটি তাঁকে দান করেন। বুদ্ধমূর্তি নেওয়ার কথা জানানো হলে উ নাগিন্দা মহাথের তাঁর শিষ্য উ প্রুসাচিং(মার্মা) ভিক্ষুকে টেকনাফে পাঠান বুদ্ধমূর্তি নিয়ে যাবার জন্য। তিনি সিএনজি ভাড়া করে টেকনাফ থেকে বুদ্ধমূর্তিসহ ফিরছিলেন।
মাঝপথে উখিয়ায় কি ঘটল ?
টেকনাফ থেকে ফেরার সময় সিএনজি চালকের সাথে আরো একজন ব্যক্তি ওঠেন। তিনি চালকের পরিচিত। গাড়ি উখিয়াতে ঢুকলে চালক এবং অপর ব্যক্তি ভান্তেকে পরামর্শ দেন যে মরিচ্চা একটা চেকপোস্ট আছে, সেখানে বিজিবি পেলে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে নিবেন। চালক বলেন, তার পরিচিত অপর ব্যক্তি বুদ্ধমূর্তিটি নিয়ে আলাদাভাবে ভিন্ন পথ দিয়ে যাবেন যাতে বিজিবি দেখতে না পান। চালক ভান্তেকে নিয়ে চেকপোস্ট দিয়ে আসবেন। পরে সবাই এক জায়গায় মিলিত হবেন। ভান্তে এই পথে নতুন হিসেবে তাদের কথায় না করলেন না। ওই ব্যক্তি একটা টমটমে করে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে ধেচুয়াপালং হয়ে আসতে চাইলেন। পথে কিছু মানুষের রোষানলে পড়ে যায়। তারা বুদ্ধমূর্তি জব্দ করার চেষ্ঠা করেন। তারা বুদ্ধমূর্তি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু করেন। সোনালী রংয়ের হওয়ায় অনেকে স্বর্ণের বুদ্ধমূর্তি বলেও ধারণা করেছিলেন। তিনি অবস্থা বেগতিক দেখে সিএনজি চালককে ফোন করলেন। চালক ভান্তেসহ ঘটনাস্থলে যান। গিয়ে দেখেন অনেক মানুষের জটলা। তারা একসময় টাকা দাবি করে বসেন। দশ হাজার টাকা দিলে বুদ্ধমূর্তি ছেড়ে দিবেন। ভান্তের সাথে এতগুলি টাকা ছিল না। যা ছিল তা দিতে চাইলে ওরা রাজী হয়না। ঘটনা অন্যদিকে মোড নিল। তাদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হয়। একপক্ষ বলেন এটা তাদের পূজার বস্তু। তাদের যেতে দাও। আরেকপক্ষ বলেন টাকা না দিলে যেতে দেয়া হবেনা। একপর্যায়ে দুইপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। পরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলায় জড়িয়ে পড়ার উপক্রম দেখা দিলে কেউ বিষযটি বিজিবিকে অবহিত করেন। বিজিবি তৎক্ষণাত ঘটনাস্থলে ছুটে যান। এমনকি বিজিবির সিও পর্যন্ত। সেখান থেকে বুদ্ধমূর্তিসহ ভান্তেকে চেকপোস্টে নিয়ে আসেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আটকের ছবি আসল কিভাবে ?
চেকপোস্টে আনার পর বিজিবি বুদ্ধমূর্তি এবং ভান্তেকে সাথে নিয়ে পোজ দিয়ে ছবি তোলেন। জনৈক সাংবাদিকদের বিজিবির পক্ষ থেকে ডাকা হতে পারে। ভান্তেকে বেশ কিছু সময় পর্যন্ত চেকপোস্টে রাখা হয়। ভান্তে বলেন, বিকাল ৩ টার দিকে তাঁকে চেকপোস্টে আনা হয়। অথচ রামু থানায় আনা হয় রাতে। আমরা জানতে পারি রাত ১০ টার দিকে। ভান্তে উনার ভাষাগত দুর্বলতা এবং দুর্বল বর্ণনার কারণে বিজিবিকে হয়তো বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে এবং পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারেননি যে তিনি বুদ্ধমূর্তিটি পাচার নয়, পূজা করার জন্য নিজের বিহারে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যার কারণে এমন লংকাকান্ড।
শেষ পর্যন্ত হল কি ?
গত রাত ১০ টার দিকে ফোনে জানতে পারি রামু থানায় একটি বুদ্ধমূর্তিসহ একজন ভিক্ষুকে রাখা হয়েছে। তখনও ঘটনার কিছুই জানতাম না। ফোনে দীর্ঘ কথা না সেরে সাংবাদিক সুনীল বড়ুয়াসহ খুব দ্রুত থানায় গেলাম। খবর তো সত্যি। ওসির অফিসে বুদ্ধমূর্তি এবং ভান্তেকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পাশে বসা ছিলেন বিজিবির কয়েকজন সদস্য। থানা প্রাঙ্গনে গাড়িসহ বিজিবির আরো কিছু সদস্য অপেক্ষামান ছিলেন। রামুতে নিয়ে আসার কারণ হল মরিচ্চা রামু থানার অধীনস্থ এলাকা। ভান্তের সাথে কথা হল। ভান্তের দেয়া ঠিকানা অনুসারে যোগাযোগ করা হল। একেবারে সঠিক ঠিকানা পাওয়া গেল। ওসি নিজেই তাদের সাথে কথা বললেন। এর পরে ভান্তে কথা বললেন। উপস্থিত সবাই নিশ্চিত হলেন যে তিনি বেশধারী কোন ভিক্ষু অথবা পাচারকারি কেউ নন। রাত বেশি হওয়াতে এত দূর থেকে কেউ আসা সম্ভব নয়। বিজিবির সিও এর সাথে কথা বললাম। উনাকে বুঝাতে পারলাম। সিও মহোদয় বিনয়ের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ ভাষায় জানালেন, আমরা উনাকে আটক করিনি, কেবল নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে এসেছিলাম। কারণ তিনি কিছু খারাপ মানুষের খপ্পরে পড়ে গিয়েছিলেন। আপনি ভালভাবে উনি গন্তব্যে পৌঁছতে পারে মত ব্যবস্থা করলে আমাদের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নেই। ওসিকে ওভার কনফার্ম করার জন্য এডিশনাল এসপি মহোদয়ের সাহায্য নিলাম। তিনি তৎক্ষনাৎ ওসির সাথে কথা বললেন। রাতে বুদ্ধমূর্তি এবং ভান্তেকে সীমা বিহারে নিয়ে আসা হল। আজকে (১ জুলাই) দুপুরে চন্দ্রঘোনা থেকে বিহারের দায়ক এবং ভান্তের গুরু আসেন। তাদের হাতে বুদ্ধমূর্তি এবং ভান্তেকে বুঝিয়ে দিয়েছি। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় চন্দ্রঘোনা পৌছার পর পর তারা আমাকে ফোনে জানান যে তারা নিরাপদে বিহারে পৌঁছতে পেরেছেন।
শেষকথাা:
রামু থানা আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন। বিজিবি বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত গভীর রাত অবধি রামু থানায় কষ্ট স্বীকার করে ছিলেন, বিশেষ করে সিও মহোদয়ের আন্তরিকতা। উখিয়ায় ঘটনাস্থলে বিজিবি না পৌঁছলে অনাকাঙ্কিত কিছু ঘটতে পারত। তবে বুদ্ধমূর্তি এবং ভান্তেকে নিয়ে অতিরিক্ত কিছু যে একেবারে হয়নি তা নয়।
এটাও বলব যে, বুদ্ধমূর্তি আনা নেয়ার প্রয়োজন হলে এভাবে লুকিয়ে করতে হবে কেন ? রাজকীয়ভাবে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে বুদ্ধমূর্তি আনা নেয়া করা যায়। রাষ্ট্র, সরকার এবং প্রশাসন তো তাতে বাধা দিচ্ছেন না। তবে তা প্রক্রিয়া মেনে করতে হবে। এসব বিষয়ে আমাদের আরো বেশি সতর্ক হতে হবে বৈকি।