অনলাইন ডেস্কঃ
সংগঠনের সব পর্যায়ে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ ভাগ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার শর্তে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে নিবন্ধন পেয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। আগামী বছরের ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে নির্ধারিত সময়। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই এই শর্ত পূরণ করতে পারেনি। আগামী এক বছরে এই শর্ত পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বড় দুই রাজনৈতিক দল বলছে, তাদের চেষ্টার কমতি ছিল না; বাস্তব কারণেই এই শর্ত পূরণ সম্ভব হয়নি।
নির্বাচন কমিশন বলছে, হাতে এখনও সময় আছে। ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বর্তমানে ৪৪টি। ২০১৭ সালের জুনে ইসির পক্ষ থেকে দলগুলোকে চিঠি দিয়ে এই শর্ত পূরণের হালনাগাদ তথ্য চাওয়া হয়েছিল। জবাবে একটি মাত্র দল গণফ্রন্ট দাবি করেছে, তারা ৩৩ ভাগ নারী নেতৃত্বের শর্ত পূরণ করেছে। তবে ইসির পক্ষ থেকে কোনো দলের তথ্যই যাচাই করা হয়নি।
ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে পরিচিত ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা আরও করুণ। নেতৃত্ব দূরে থাক, বেশিরভাগ দলে সদস্য হওয়ারও সুযোগ রাখা হয়নি নারীদের। তাদের অনেকেই বলছেন, এই ধারা ইসলাম পরিপন্থি।
আরপিও সংশোধন হতে পারে :
ইসির কর্মকর্তাদের মতে, বেশিরভাগ দল শর্ত পূরণ করতে না পারায় আইন সংশোধন করে সময় বাড়াতে হবে। এজন্য চলতি বছরেই আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব কমিশন থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। পরে তা সংসদের বিবেচনার জন্য উঠবে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, নির্ধারিত সময় শেষ হলে বিষয়টি কমিশন বিবেচনা করবে। আগেভাগেই এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে না।
২০০৮ সালে নিবন্ধনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোতে সর্বোচ্চ নারী নেতৃত্বের হার ছিল শতকরা ১০ ভাগ। আইনে শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও গত ১১ বছরে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। গত ১১ বছরে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী নেতৃত্ব বাড়ার হার দশ ভাগেরও নিচে। ফলে, ইসির বেঁধে দেওয়া বাকি সময়ের মধ্যে আরও ১২ থেকে ১৫ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করা অসম্ভব ব্যাপার।
আরপিওতে বলা আছে- ‘নিবন্ধনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ ভাগ সদস্যপদ মহিলা সদস্যদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা থাকবে; যা ২০২০ সালের মধ্যে অর্জন করা হবে।’
বিশ্নেষকদের মতে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে ঠিকই। তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সামাজিক বাস্তবতায় সংখ্যা পূরণের জন্য নারী নেতৃত্ব ৩৩ ভাগে আনা যে কোনো সময়েই সম্ভব। কিন্তু তা টিকে থাকবে না। দক্ষতা অর্জন করেই নারীকে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আসতে হবে। তবেই সে নেতৃত্ব টেকসই হবে। তবে কতদিনের মধ্যে এই লক্ষ্য পূরণ হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি বড় দলগুলো।
ইসির শর্ত মেনে নিবন্ধ নেওয়ার সময় বড় দলগুলোতে গড়ে ১০ ভাগের মতো নারী নেতৃত্ব ছিল। সামনের ১২ বছরে আরও ২৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব বাড়াতে পারলে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতো। কিন্তু এর মধ্যে ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও দলগুলো কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১০ ভাগের বেশি নারী নেতৃত্ব বাড়াতে পারেনি। তৃণমূলে এই হার আরও কম। ২০০৮ সালে দলগুলোর নারী নেতৃত্বের অবস্থান ও গত ১১ বছরের বৃদ্ধি মিলিয়ে বর্তমানে তারা ২০ ভাগেও পৌঁছাতে পারেনি। ফলে, বাকি এক বছরের মধ্যে দলগুলোকে নারী নেতৃত্ব ১২ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়াতে হবে।
ধারা সংশোধন করেছে আ’লীগ :
এদিকে আওয়ামী লীগের সদ্য সমাপ্ত কাউন্সিলে দলের গঠনতন্ত্রের এ-সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করা হয়েছে। এতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার সময়সীমা এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ করা হয়েছে। ইসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের এই সংশোধনী আইনসিদ্ধ হয়নি। আওয়ামী লীগের এ কাউন্সিলকে ঘিরে সারাদেশে দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ২৯টির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এর বেশিরভাগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না হলেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে একজনও নারী নেই। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হিসেবে বিবেচিত সভাপতিমণ্ডলীর ১৯ সদস্যের মধ্যে চারজন মাত্র নারী সদস্য। এর মধ্যে সর্বশেষ কাউন্সিলে যে নতুন তিনজন স্থান পেয়েছেন তারা সকলেই পুরুষ। চারজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে নারী মাত্র একজন। কাউন্সিলে আটজন সাংগঠনিক সম্পাদক পদের বিপরীতে পাঁচজনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে সেখানেও কোনো নারী নেই।
ইসির নিবন্ধন নেওয়ার সময় আওয়ামী লীগে নারী নেতৃত্ব ছিল প্রায় ১১ ভাগ। এরপর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাইয়ের সম্মেলনে সভাপতি শেখ হাসিনাসহ ৭৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১২ জন নারী জায়গা করে নেন। ফলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীর অবস্থান দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৪৪ ভাগে। ২০১২ সালের সম্মেলনের পর এই সংখ্যা একজন কমে। ২০১৬ সালের সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ জনে। ওই সম্মেলনে কমিটির আকার বাড়িয়ে ৭৩ থেকে ৮১ করা হয়। এ হিসাবে নারী নেতৃত্বের হার দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৪৮ ভাগে। এদিকে, সরাসরি ও সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত এমপি মিলিয়ে আওয়ামী লীগের মোট নারী এমপি রয়েছে ২১ ভাগ। আওয়ামী লীগের সম্প্রতি বিলুপ্ত কমিটিতে নারীর সংখ্যা ছিল ১৯ ভাগেরও কম। ২১তম জাতীয় কাউন্সিলের পর ঘোষিত আংশিক কমিটিতেও এ সংখ্যা আগের তুলনায় বাড়েনি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি এমপি বলেন, কতদিনে ৩৩ ভাগ নারী নেতৃত্ব পূরণ করা সম্ভব হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ বিষয়টিকে সংখ্যার বিচারে দেখা যৌক্তিক হবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে দলের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনেছে। তারা লক্ষ্য পূরণের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে ২০২১ সাল। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের মূল কমিটির বাইরেও পুরোপুরি নারীদের নিয়ে কয়েকটি সহযোগী সংগঠন রয়েছে। মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও মহিলা শ্রমিক লীগে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রে ১৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব :
২০১৭ সালে ইসিতে চিঠি দিয়ে বিএনপি ২০২০ সালের মধ্যে সংগঠনের সব স্তরে ৩৩ ভাগ নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। বর্তমানে বা ২০১৬ সালের ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে ১৬ জন সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়াসহ নারী সদস্য মাত্র দু’জন। যুগ্ম মহাসচিব পদের ৭ জনই পুরুষ। আর ১০ সাংগঠনিক সম্পাদকের দুটি পদে আছেন নারী। কেন্দ্রীয় কমিটির ৫০২ জনের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৬৬ জন অর্থাৎ শতকরা ১৩ ভাগের কিছু বেশি।
এর আগে ২০০৮ সালে নিবন্ধন নেওয়ার সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী নেতৃত্ব ছিল ১০ ভাগের কিছু কম। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে দলের পঞ্চম কাউন্সিলে ৩৮৬ সদস্যের কমিটিতে নারী ছিলেন ৪৬ জন। শতাংশ হারে ১১ দশমিক ৯১ ভাগ। ২০১৭ সালে ইসিতে দেওয়া চিঠিতে বিএনপি দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ১৫ ভাগ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির দাবি করেছিল।
এ বিষয়ে সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, নারী নেতৃত্ব বিকাশে তাদের দল সচেষ্ট রয়েছে। যোগ্য ও দক্ষ নারী নেতৃত্ব আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ ভাগ পূরণ না হলেও কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই তারা তা করতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি। দলের আসন্ন কাউন্সিলে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বড় দুই দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও তৃণমূলের কয়েকটি সাংগঠনিক জেলা কমিটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তৃণমূলের তুলনায় কেন্দ্রে নারীর অংশগ্রহণ বেশি। তবে উভয় ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নারীনেত্রীর সংখ্যা বিএনপির তুলনায় বেশি।
অন্যান্য দলে নারী নেতৃত্ব :
সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে বর্তমানে নারী নেতৃত্বের হার প্রায় ১০ ভাগ। দলটি ইসির চিঠির জবাবে জানিয়েছিল, তাদের দলে নারী নেতৃত্ব ২০ ভাগ রয়েছে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির দশম কংগ্রেস হয় ৫ নভেম্বর। সেখানে ৯১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হলেও নারী রয়েছেন মাত্র আটজন। শতকরা হিসেবে মাত্র ৭ ভাগ। অন্য দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি-সিপিবিতে ১৩ দশমিক ৩৩ ভাগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদে ১১ দশমিক ৯২ ভাগ নারী নেতৃত্ব রয়েছে। এছাড়া ইসিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নারী নেতৃত্ব রয়েছে ২০ ভাগ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগে ৬ ভাগ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ১২ ভাগ, গণতন্ত্রী পার্টিতে ১৫ ভাগ ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টে এক ভাগ নারী নেতৃত্ব রয়েছে। তবে জাতীয় পার্টি (জেপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাকের পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপসহ অন্য দলগুলো ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ ভাগ প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রচেষ্টার কথা জানিয়েছে ইসিকে।
ইসিতে জমা দেওয়া তথ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩৩ ভাগ নারী নেতৃত্ব পূরণের দাবি করা গণফ্রন্টের সভাপতি অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন বলেন, তাদের ৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে ১৭ জন নারী রয়েছে। বাকি এক বছরের মধ্যে তাদের সব কমিটিতে এ কোটা পূরণ করা হবে। ২০১৫ সাল থেকেই তারা নারীর সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে কমিটি গঠন করছেন বলেও জানান তিনি।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোতে নারী নেতৃত্ব :
এদিকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কোনো পর্যায়েই নেই নারী নেতৃত্ব। এমনকি অনেক দল এখন এ নিয়মের বিরোধিতাও শুরু করেছে। তাদের দাবি, নারী নেতৃত্বে আসতে পারে, কিন্তু পর্দা, শরিয়ত এগুলো লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সর্ববৃহৎ ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী আদালতের নির্দেশে নিবন্ধন হারিয়েছে। এর বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফতে মজলিশ, খেলাফতে আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিশের মতো দলগুলোতে নারীরা শুধু দলীয় কর্মী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। নিবন্ধন পাওয়ার সময় দলের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণের বিধান মেনে নিলেও, এখন তা মানতে চাইছেন না তারা। কেউ কেউ ইসির এ ধারাকে ‘ইসলাম পরিপন্থি’ বলেও মনে করছেন।
সূত্রঃ সমকাল