
আসিফ নুরঃ ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’র প্রথম প্রহর বছর ঘুরে প্রতিবার আমাদের কাছে আসে লক্ষ ফুলের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিবেদনে একাকার অমলিন ভাবগাম্ভীর্যে।
একুশের প্রথম প্রহরকে বর্ণাঢ্য বরণের পূর্বপ্রস্তুতি চূড়ান্ত হয় বিশের শেষ প্রহর শেষের অনেক আগেই। বিশের শেষ ভাগেই শুরু হয়ে যায় একুশ বরণের বিশেষ পদযাত্রা। কারণ রাত ১২টা ০১ মিনিটেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শুরু হবে দুঃখীনি জননী শহীদ মিনারের কোলে। ‘মায়ের ভাষায় কথা বলাতে/ স্বাধীনতার পথ চলাতে/ হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ’, সেইসব মহান আত্মাদের সম্মিলিতভাবে জানাতে হবে ‘ সালাম সালাম হাজার সালাম’।
যে কোনো মিছিল মানেই শ্লোগানে শ্লোগানে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে ফেটে পড়া এক শব্দবাজ সক্রিয়তা। কিন্তু একুশমুখী শহীদ মিনারগামী মিছিলটি একেবারেই নীরবএটির নামই মৌনমিছিল। মৌনতার শক্তি কেমন? জনপ্রিয় উত্তর ‘অনেক কথা যায় যে বলা/ কোনো কথা না বলি’। তাই বুঝি একুশে মৌনমিছিলের সারথীদের মুখে কোনো কথা ফোটে না। হাতে হাতে ফোটে শুধু ফুল আর বর্ণপ্রেমী নানান বরন ব্যানার-ফেস্টুন-প্লাকার্ড। ফুলেদের নানান নামগোলাপ, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়া, রজনীগন্ধাআরো কত কি! ফুলেদের আকার-প্রকারও হরেক রকমএকক, তোড়া, ডাঁটা, মালা, চাক্তি ইত্যাদি।
এমন মিলনমেলায় জড়ো হয় শিশু-কিশোর-যুবা-প্রৌঢ়-বৃদ্ধ সবাই। পূর্বপ্রজন্মের কাছ থেকে নতুনরা শিখে নেয় বাঙালির ভাষা আন্দোলনের রক্তলাল ইতিহাস শহীদ মিনারের অশ্রুসজল জন্মগাঁথা।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ এই অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। কারণ তখন সারা পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি। পক্ষান্তরে বাংলাভাষী ছিল ৫৬ শতাংশ। বাকিরা ছিল সিন্ধি, পস্তু ও অন্যান্য ভাষাভাষী। ফলে ছাত্রদের সাথে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী ও অন্যান্য ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত ও সংগঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’।
সংগঠনের পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘ভাষা দিবস’ ঘোষণা করে সমগ্র পূর্ববাংলায় সর্বাত্মক ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ও জনসভার আহ্বান জানানো হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের আগুন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে গেলো সবখানে। শাসকদল ২০ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকেই ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু কালাকানুন ভঙ্গ করে পরদিন সকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সভাস্থলে জড়ো হলো ২০-২৫ হাজার ছাত্র। যোগ দিল সাধারণ জনতা। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠলো চারদিক।
টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জের পর বিকেল তিনটার পর বেপরোয়া গুলি ছুঁড়লো পুলিশ। লুটিয়ে পড়লো রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের মতো আরো বহু দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা। তাঁদের সম্মানে ও স্মরণে পরদিনই ঘটনাস্থলে নির্মিত হলো শহীদ মিনার। নিজের ভাষার জন্য এতোগুলো তাজা প্রাণ এভাবে আত্মাহুতি দিয়েছেন, পৃথিবীতে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু বাঙালির ‘শহীদ দিবস’ই নয় গোটা দুনিয়ার জন্য ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে ছেষট্টির ছয় দফা। তারপর উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের হাত ধরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। এজন্যেই বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক অনিবার্য মাইল ফলক। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে এতো গুরুত্বপূর্ণ দিন।
একুশের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের সব শহরের সমস্ত সড়ক মৌনমিছিলের স্রোতস্বিনী নদী। ফুল আর মানুষের ঢেউয়ে ঢেউয়ে সব নদীর নিশানা মোহনার দিকে মোহনার নাম শহীদ মিনার। পরম শ্রদ্ধার ও গভীর ভালোবাসার প্রিয় পুষ্পার্পণ শেষে এক টুকরো ঘুমের আশায় মানুষেরা বাড়ি ফিরে যায় কারণ আরেক প্রহর পরেই প্রভাতফেরি।
শহীদবেদীতে গা জড়াজড়ি করে ফুলেরাও একে একে ঘুমিয়ে যায়। শুধু একা জেগে থাকে শহীদ মিনার আমাদের জনমদুখিনী মা। কেননা মা জানে, আগামী ভোরের আগেই শেষরাতের যে কোনো সময়ে তার সূর্যসন্তানদের অমর আত্মারা আসবে নীরব ভ্রমণে। তাই মায়ের এই নিশিজাগা ব্যাকুল প্রতীক্ষা কখন ‘ওরা আসবে চুপিচুপি/ যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’।
লেখক: কবি
[email protected]