একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলার ১২ বছর পার হতে চললেও আলোচিত সে ঘটনায় দায়ের মামলার বিচার শেষ হয়নি এখনও।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আসামিপক্ষ ‘নানা উছিলায়’ বিচার পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আছে। আর আসামিপক্ষ বলছে, ‘অপ্রাসঙ্গিক সাক্ষীদের’ এনে বিচারের নামে সময় নষ্ট করছে রাষ্ট্রপক্ষ। খবর বিডিনিউজের।
এরমধ্যে শনিবার এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলার রায় ‘অল্প কিছুদিনের’ মধ্যে হবে।
তবে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমানের কথায় স্পষ্ট, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হতেই এই বছর লেগে যেতে পারে।
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় দলটির তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ’ আহত হন।
সন্ত্রাসবিরোধী ওই সমাবেশের প্রধান অতিথি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ামাত্র গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অভিযোগপত্র দিয়ে বিচার শুরু হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অধিকতর তদন্ত হয়। এতে আসামির তালিকায় যোগ হন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ ৩০ জন।
এরপর দ্রুতবিচার আদালতে থেকে দায়রা আদালত ঘুরে এসে আবার ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ চলছে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা মামলা দুটির বিচার।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলার প্রধান পরিচালনাকারী সৈয়দ রেজাউর রহমানের কাছে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ এ বছরই শেষ হয়ে যাবে।
তিনি জানান, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে হবে আসামিপক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানি; তারপর যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা হবে।
রেজাউর রহমান বলেন, “আসামিপক্ষ নানা উছিলায় নানা কথা বলে বিচার পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। তারা নানা রকমের আবদার নিয়ে উচ্চ আদালতে যাচ্ছে।”
আসামি পক্ষের অন্যতম আইনজীবী আবদুস সোবাহান তরফদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ অপ্রয়োজনীয় অপ্রাসঙ্গিক সাক্ষীদের আদালতে তলব করে বিচারের নামে সময় নষ্ট করছে, বিচারকের সময় অপচয় করছেন।”
নথিপত্র থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম দিকে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমার আগের ১ থেকে ৬১ নম্বর ক্রমিকের সাক্ষীদের জেরা করতে পুনরায় তলব (রিকল) আবেদন করে আসামিপক্ষ।
আবেদনটি ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন নাকচ করলে আসামিপক্ষ হাই কোর্টে যায়। তবে হাই কোর্টের কোনো আদেশ অথবা শুনানির তথ্য আদালতে দিতে না পারায় বিচারক রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত রেখেছেন।
মামলায় গত মার্চের মাঝামাঝিতে প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আমির হোসেনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর জুনে দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবিরের সাক্ষ্য নেওয়া শুরু করেন বিচারক।
ফজলুল কবির রাষ্ট্রপক্ষের ২২৪তম সাক্ষী। আগামী ২২ ও ২৩ অগাস্ট তাকে আসামিপক্ষের আরও কয়েকজনের অবশিষ্ট জেরা করার দিন রয়েছে।
ফজলুল কবিরের সাক্ষ্য শেষে অধিকতর তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির জ্যেষ্ঠ বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দের সাক্ষ্য নেওয়া হবে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম কৌঁসুলি আবু আবদুল্লাহ ভূইয়া।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ বাংলাদেশের কয়েকটি আলোচিত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন কাহার আকন্দ।
গ্রেনেড হামলা মামলায় গত ১ জুন ২২৪তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন সিআইডির ফজলুল। তারপর প্রত্যেক সপ্তাহে দুটি ধার্য তারিখে তার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
সর্বশেষ ধার্য তারিখ ১৬ অগাস্ট দুই মামলারই অন্যতম আসামি হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের পক্ষে তাকে জেরা করেন তার আইনজীবী সাইফুর রশীদ সবুজ।
এর আগে মামলায় ফজলুল করিকে জেরা করেন আসামি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, সিআইডির সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমান ও আব্দুর রশিদ এবং বিশেষ সুপার রুহুল আমিনের আইনজীবী সোবাহান তরফদার।
সাবেক শিক্ষা উপ-মন্ত্রী আব্দুস সালম পিন্টুর পক্ষে এ তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
ফজলুল কবিরকে এখনও মামলার অন্যতম আসামি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষে জেরা করা হয়নি।
২২ অগাস্ট তার পক্ষে তাকে জেরা করার কথা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টি এম আকবরের। এছাড়া আরও কয়েকজন আসামির পক্ষেও তাকে জেরা করা হয়নি।
মামলায় বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং বিএনপি আমলের তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম জামিনে রয়েছেন।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৪ জন কারাগারে আছেন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জেল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জন আসামি এখনও পলাতক।
মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও আসামি ছিলেন। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
শনিবার জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “মামলাটি এখন শেষ পর্যায়ে। আশা করা যায়, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মামলাটির রায় হবে।”
মামলায় পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।