সোয়েব সাঈদ:
‘একটি সমস্বর আড্ডা’ ব্যানারে কেবল এটুকু বাক্যই শোভা পেয়েছিলো। তবে শিল্প-সাহিত্য, এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়েই কেবল আড্ডা সীমাবদ্ধ থাকেনি। কথা, গল্প, গান, ছড়া, কবিতায় সেটি রূপ নেয় মুখরিত আড্ডায়। ব্যতিক্রমী এ আড্ডা’র আয়োজন করে কক্সবাজারের রামু উপজেলার প্রতিনিধিত্বশীল নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সমস্বর।
গত ৩ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টায় রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কক্ষে আয়োজিত এ আড্ডা’য় অংশ নেন, রামুর সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। অংশ নেন, আড্ডা প্রিয় তরুণ শিক্ষার্থীরাও।
আড্ডায় অংশ নিয়ে আলোচকরা বলেন, বাঙ্গালীর স্বকীয় স্বত্ত্বাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হলে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে হৃদয়ে লালন করতে হবে। তাদের আদর্শকে চর্চা করেই দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।
আড্ডায় সভাপতিত্ব করেন, রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তণ প্রধান শিক্ষক সাধন কুমার দে। শুরুতে আয়োজক ‘সমস্বর’ এর নির্বাহী পরিচালক মাস্টার মোহাম্মদ আলম বলেন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, শিক্ষাসহ নানাক্ষেত্রে রামুর ঐতিহ্য সুদীর্ঘকালের। কিন্তু মুক্তবুদ্ধি চর্চা না থাকা, পৃষ্ঠপোষকতা আর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস না থাকায় রামু অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই সব মহলের প্রচেষ্টায় হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এলক্ষ্য বাস্তবায়নই সমস্বর আড্ডার মূল উদ্দেশ্য।
রামু কলেজের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী অধ্যাপক সুপ্রতিম বড়ুয়া বলেন, আড্ডা হলো সৃজনশীলতা বিকাশের অন্যতম মাধ্যম। আড্ডা হতে হবে শিক্ষনীয় ও সমাজের কল্যাণমূলক উদ্দেশ্য নিয়ে। লেখালেখি নিয়ে উৎকর্ষতা অর্জনও আড্ডার লক্ষ্য হতে হবে। আড্ডায় যেন অংশগ্রহনকারিরা স্ব স্ব লেখা গল্প, ছড়া-কবিতা নিয়ে আসেন। আর তা নিয়ে আলোচনা হলেই প্রকৃত কলম সৈনিক সৃষ্টি হবে।
রামু কেন্দ্রিয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক ও আমাদের রামু সম্পাদক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, সমাজে চলমান অস্থিরতা ও নানা সমস্যায় মানুষ জর্জরিত। কোথাও ঐক্য বা শৃংখলা নেই। অথচ আড্ডার মাধ্যমে সমাজের অনেক সমস্যা সমাধান আর ভালো কাজের দিক চিহ্নিত করা যায়। সমস্বর এর এ আয়োজন তাই প্রশংসার দাবি রাখে। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতেই হবে। এতে আড্ডার সফলতা আসবেই।
আড্ডায় অধ্যাপক নীলোৎপল বড়ুয়া বলেন, আমাদের আরো সংস্কৃতিবান্ধব হতে হবে। সংস্কৃতিকর্মীদের ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বোচ্ছার হতে হবে। আদর্শিকভাবে সংস্কৃতিকর্মীদের মানবিক মানুষ হতে হবে। সংস্কৃতিকর্মীরা মানবিক হলেই সমাজে চলমান অস্থিরতা দূর হবে।
সমস্বর এর সভাপতি বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী তানভীর সরওয়ার রানা, সাধারণ সম্পাদক মিজানুল হক ও সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল আলমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আড্ডায় অংশ নেন, প্রবীন সংগীত শিল্পী প্রবীর বড়ুয়া, রামু কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক সুপ্রতিম বড়ুয়া, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ননী গোপাল দে, রামু কেন্দ্রিয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক ও আমাদের রামু সম্পাদক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, বাংলাদেশ বেতার কক্সবাজার কেন্দ্রের সংগীত প্রযোজক বশিরুল ইসলাম, রামু কলেজের শিক্ষক কন্ঠশিল্পী মানসী বড়ুয়া, সমস্বর এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক নীলোৎপল বড়ুয়া, হাফেজ আহমদ, ইউনুচ রানা চৌধুরী, রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নাজনীন আকতার, বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান ঘোষক জয়নাল আবেদিন, সাংবাদিক ও ছড়াকার সোয়েব সাঈদ প্রমূখ।
আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চলে গান ও ছড়া-কবিতা। প্রবীর বড়ুয়ার সাথে উপস্থিত শিল্পীরা সমবেত কন্ঠে গেয়ে উঠেন, ‘কপি হাউসের সেই আড্ডা আজ আর নেই, আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই’।
সবার পরিচিত মুখ মানসী বড়ুয়া গেয়ে শোনান ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’।
নাজনীন সুলতানা জোনাকী তার দরদী কন্ঠে গেয়ে শোনান, ‘এ শুধু গানের দিন, এলগনও গান শোনাবার’ এবং ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’।
কালজয়ী ‘অভিনন্দন নয়, প্রশংসা নয়, নয় কোন সংবর্ধনা’ সহ সংগীত বড়ুয়ার কন্ঠে গাওয়া দুটি সংগীত আড্ডা পাগল মানুষদের সুরের মূর্ছনায় বিমোহিত করে।
‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু। কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু’ সমস্বর এর সাধারণ সম্পাদক মিজানুল হকের গাওয়া এ গানটি আড্ডায় মুখরিত সন্ধ্যাকে সত্যিই স্বর্ণালী করে তোলে। আড্ডাবাজদের হৃদয়ে এঁকে দেয় রক্তিম পলাশের স্বপ্ন।
অনুষ্ঠানে সমস্বর এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক নীলোৎপল বড়ুয়া সদ্য প্রয়াত সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘নুরুল দীনের সারাজীবন’ থেকে আবৃত্তি করে শোনান। এছাড়া
সমস্বর এর সভাপতি তানভীর সরওয়ার রানা, বেতারের অনুষ্ঠান ঘোষক জয়নাল আবেদিন ও তরুন কবি আবু হেনার কবিতা আড্ডায় আসা সাহিত্যপ্রাণ ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করে।
আড্ডায় স্বরচিত ছড়া ‘লোকাল বাস’ পরিবেশন করেন সংবাদকর্মী সোয়েব সাঈদ।
সমস্বর এর সাধারণ সম্পাদক মিজানুল হক বলেন, আমরা চাই সমাজে ভালো কাজের চর্চা হোক। আড্ডা আয়োজনের লক্ষ্যও তাই। ভবিষ্যতে আড্ডার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে তিনি সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন।