‘মঙ্গল আলোয় উদ্ভাসিত হোক সকল সৃজন’ এ শ্লোগানে গতকাল বুধবার শেষ হয়েছে কক্সবাজার থিয়েটার নাট্যোৎসব। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সেরা নাট্যদলের অংশগ্রহণে কক্সবাজার ইনস্টিটিউট ও পাবলিক লাইব্রেরির শহীদ সুভাষ হলে সাত দিনব্যাপী নাট্যোৎসবের যবনিকা ঘটেছে। বুধবার (৩১ মে) রাতে এই নাট্যোৎসবের সমাপনী অনু্ষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান।
কক্সবাজার থিয়েটারের ৪০ বছর উদযাপনে আয়োজিত এ নাট্যোৎসবের সমাপনী দিন বুধবার সন্ধ্যায় মঞ্চায়ন করা হয়, ঢাকা অনুস্বর নাট্যদলের নাটক ‘মূল্য অমূল্য’। আর্থার মিলারের মূল নাটকটি ভাবানুবাদ করেছেন অসিত মুখোপাধ্যায়। ‘মূল্য অমূল্য’ নাটক ভাবান্তর ও নির্দেশনায় ছিলেন মোহাম্মদ বারী।
মুনাফাভিত্তিক রাষ্ট্র, সমাজ আর বাজার অর্থনীতির আগ্রাসনে ভেঙ্গে পড়া যৌথ পারিবারিক বোধের চরম মূল্য চুকানোর গল্প ‘মূল্য অমূল্য’। যেখানে বাবার ব্যবহৃত পুরনো আসবাবপত্র নিলামে বিক্রি করছে তার দুই পুত্র রঞ্জু ও মঞ্জু । তাদের মাঝে উপস্থিত চতুর নিলামদার খোদাবক্স। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছাপিয়ে বিপরীতমুখী চরিত্রের দুই ভাইয়ের মধ্যে শুরু হয় অতীত নিয়ে দ্বিধা, বর্তমান নিয়ে হতাশা আর ভবিষ্যত নিয়ে টানাপোড়েন। দুই ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের এই দ্বন্দ্ব আর যুক্তি- তর্কের মাঝে উঠে আসে আদর্শিক পাকচক্র, আসে লোভ, শঠতা, অনিশ্চয়তা, ষড়যন্ত্র আর হতাশাগ্রস্ত সময়ের বয়ান। অপরাধবোধ আমাদের সবাইকে এক সময় দাঁড় করিয়ে দেয় সময়ের আয়নার সামনে। সম্পর্কের মাঝেও কি তাহলে শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন আসে হারা জেতার, নাকি তা টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় কাউকে কাউকে চুকাতে হয় জীবনের অমূল্য মূল্য ।
সাত দিনব্যাপী কক্সবাজার থিয়েটার নাট্যোৎসব ২৫ মে চট্টগ্রামের ওড়িশী অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টারে পরিবেশনায় প্রমা অবন্তী’র নৃত্য ভাবনায় ‘আলোয় আলোয় জাগো’ নৃত্যানুষ্ঠান দিয়ে শুরু হয়। নৃত্যানুষ্ঠানের পর মঞ্চায়ন হয় চট্টগ্রামের কথাসুন্দর নাট্যদলের পরিবেশনায় কুন্তল বড়ুয়া’র নির্দেশনায় নাটক ‘বৃত্তের বাইরে’। নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিনে (২৬ মে) মঞ্চায়ন করা হয়, ঢাকার প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলে পরিবেশনায় নূনা আফরোজের নির্দেশনায় নাটক ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’। তৃতীয় দিনে (২৭ মে) মঞ্চায়ন করা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের পরিবেশনা ও অসীম দাশের নির্দেশনায় নাটক ‘কিনু কাহারের থেটার’। চতুর্থ দিনে (২৮ মে) মঞ্চায়ন করা হয় কক্সবাজার থিয়েটারের পরিবেশনা ও স্বপন ভট্টাচার্য্যে নির্দেশনায় নাটক ‘দেনাপাওনা’। পঞ্চম দিনে (২৯ মে) মঞ্চায়ন করা হয়, ঢাকার জাগরণী থিয়েটারের পরিবেশনা ও দেবাশীষ ঘোষের নির্দেশনায় নাটক ‘রাজার চিঠি’। ষষ্ঠ দিনে (৩০ মে) চট্টগ্রামের ”নান্দীমুখ’ এর পরিবেশনা ও অসীম দাশের নির্দেশনায় একক অভিনয় নাটক ‘আমার আমি’ মঞ্চায়ন করা হয়।
এ নাট্যোৎসবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, কক্সবাজার থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট তাপস রক্ষিত। তিনি বলেন,
তারুণ্যের উচ্ছ্বাসায় ১৯৮৪ সালে অপসংস্কৃতির বাঁধভাঙ্গা জোয়ার, গণতন্ত্রের নামে যথেচ্ছাচার, রাজনৈতিক দুঃশাসনের গিলোটিন-অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনকে প্রতিপক্ষ করে সাহসী তারুণ্যের ঊষালগ্নে অনেকটা অভিভাবকহীন পথচলা শুরু হয় কক্সবাজার থিয়েটারের। প্রচণ্ড প্রতিকূলতা, বিপদসংকুল সময় সত্ত্বেও শুদ্ধ সংস্কৃতির আলপথ থেকে থিয়েটার সরে দাঁড়ায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে গেঁথে, সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকারে শুরু হয় আমাদের কর্মকাণ্ড।
কক্সবাজার থিয়েটার বিশ্বাস করে শিল্পের জন্য শিল্প নয়-মানুষের জন্য শিল্প, জীবনের জন্য শিল্প। চার দশক পূর্তিতে সাতদিন ব্যাপী নাট্যোৎসব আজ সফল। আমাদের প্রত্যাশা ছিলো কক্সবাজারের মানুষের ভালোবাসা আমরা পাবো। কক্সবাজার থিয়েটারের নাট্যোৎসব মানুষ গ্রহণ করেছে। আমরাও অনুপ্রাণিত হয়েছি।
কক্সবাজার থিয়েটারের সাত দিনব্যাপী নাট্যোৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, কক্সবাজার ইনস্টিটিউট ও পাবলিক লাইব্রেরি মাঠের খোলামঞ্চে। সমাপনী অনু্ষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, নাট্যোৎসব শুধু জেলা পর্যায়ে নয়, উপজেলা পর্যায়েও নাট্যোৎসবের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে গ্রুপ থিয়েটারের যে আবেদন, সেটা জনগণ আরও কাছ থেকে উপভোগ করতে পারবেন। সাত ব্যাপী নাট্যোৎসব আয়োজন করায় তিনি কক্সবাজার থিয়েটারকে ধন্যবাদ জানান।