জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীনদের টানা ১৫তম এবং দেশের ৫২তম বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার (১ জুন) সংসদে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন তিনি। এবার তার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ছিল ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখার লক্ষ্যে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অঙ্কের বাজেট। এটি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি।
বাজেটের ব্যয় মেটাতে মোট কর আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৬৭ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা বেশি।
আগামী অর্থবছরে ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের, যেখানে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার কথা বলা হয়েছে। মোট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
নতুন বাজেটে এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও এনবিআর বহির্ভূত কর আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া সরকারের আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা আগের বছরের চেয়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে ঘাটতি রাখা হয়েছে জিডিপির ৫.২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ (অনুদানসহ) ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বিদেশি ঋণ বাবদ পাওয়া যাবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থাপনা থেকে নেবে ১ লাখ ২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে নেবে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে নেবে ৫ হাজার কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি
নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার যেভাবেই হোক আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লাগাম ৬ শতাংশের মধ্যে টেনে রাখতে চায়। নতুন অর্থবছরের জিডিপি হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। মোট জিডিপির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
বৈদেশিক ঋণ
চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা বেশি বৈদেশিক ঋণ আগামী অর্থবছরে নেওয়া হবে। ঋণগ্রস্ত বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বেশি টাকা গুনতে হবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৮৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা।
আয়ের লক্ষ্য
আগামী অর্থবছরে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ আয়ের প্রধান উৎস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআর-বহির্ভূত কর ২০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, কর ব্যতীত প্রাপ্তি (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্য হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বৈদেশিক অনুদান সরকারকে পরিশোধ করতে হবে না।
যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে
জনস্বার্থ ও দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে শুল্ক কর ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এর ফলে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য, পোশাক ও ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতির দাম কমতে পারে। যেমন– মাংস, এলইডি বাল্ব ও সুইচ-সকেট, ই-কমার্সের ডেলিভারি চার্জ, মিষ্টি, কীটনাশক, স্প্রেয়ার মেশিন, হাতে তৈরি বিস্কুট ও কেক, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার ওষুধ, পশুখাদ্য, অপটিক্যাল ফাইবার, উড়োজাহাজ ইজারা, কনটেইনার, ব্লেন্ডার, জুসার, প্রেশার কুকারের মতো গৃহস্থালি সরঞ্জাম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা আরও দুই বছর (২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) বহাল থাকবে। একই সুবিধা পাবে ওয়াশিং মেশিন এবং মাইক্রোওয়েভ ও ইলেকট্রিক ওভেন উৎপাদনকারী কারখানা। তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার পণ্য উৎপাদনে অব্যাহতি সুবিধা তিন বছর (২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) বাড়ানো হয়েছে। রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনে এখনকার ৫ শতাংশের অধিক ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ এক বছর বাড়বে। স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতেও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আরও এক বছর থাকবে। সাবান ও শ্যাম্পুর দুটি কাঁচামালে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা এক বছর বহাল রাখা হচ্ছে।
যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে
বাজেটে বেশ কিছু পণ্যে শুল্ক আরোপ বা আগের চেয়ে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে দামি গাড়ি, বাইসাইকেল, নির্মাণ সামগ্রী, জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন, সিগারেট, বাসমতি চাল, কাজুবাদাম, সোনা, খেজুর, সিমেন্ট, রড, বিদেশি আঠা বা গ্লু , ভ্রমণ খরচ, প্লাস্টিকের গৃহস্থালি পণ্য, ফ্রিজ, ফ্যান ও এক্সেলেটর, টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, টিস্যু, ন্যাপকিন, কোমল পানীয়, ওভেন, কলম, চশমা ও এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়তে পারে।
দেশ-বিদেশ ভ্রমণে কর বাড়ছে
দেশের অভ্যন্তরে আকাশপথে ভ্রমণ করের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে এ প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আকাশপথে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে যাত্রীদের ২০০ টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে। এছাড়া, বিমানে এক জেলা থেকে অন্য জেলা ভ্রমণেও দিতে হবে কর। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশ যেতে স্থলপথের কর ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা এবং নৌপথের কর ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে ১২০০ টাকা কর দিতে হয়। সেটা বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। আর অন্য দেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণকারীকে তিন হাজার টাকা কর গুনতে হয়। এটি বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হয়েছে।
বাজেটের কোথাও নেই পুঁজিবাজার
প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের ১৯ লাখ বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো সুখবর নেই। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল, গতিহীন পুঁজিবাজারে গতি ফেরার জন্য বাজেটে কর্পোরেট কর কমানোর পাশাপাশি দ্বৈত কর প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় পুঁজিবাজার সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করেননি। তিনি বিভিন্ন ধরনের যে কর কাঠামোর প্রস্তাব করেছেন, তাতেও পুঁজিবাজারের জন্য কোনো ছাড় নেই। তবে পুঁজিবাজারে বাড়তি কিছু চাপিয়েও দেওয়া হয়নি এবারের বাজেটে। এতে কিছুটা স্বস্তি পাবেন বিনিয়োগকারীরা।
সংসদ নির্বাচনসহ ইসির বরাদ্দ আড়াই হাজার কোটি টাকা
এই অর্থবছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) এজন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে আড়াই হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ৭০ শতাংশ। ইসির জন্য বরাদ্দ দেওয়া বেশির ভাগ অর্থই ব্যয় হবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে।
তারকা হোটেল নির্মাণে রেয়াতি সুবিধা বিলুপ্ত
আগামী অর্থবছর (২০২৩-২৪) থেকে তারকা হোটেল নির্মাণে সংশ্লিষ্ট রেয়াতি প্রজ্ঞাপন বিলুপ্ত ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে বলেছেন, বর্তমানে দেশে বৃহৎ আকারের এবং উন্নতমানের হোটেল গড়ে উঠেছে। হোটেল শিল্পকে রেয়াতি সুবিধা প্রদানের জন্য প্রায় এক দশক আগে হোটেল নির্মাণ সংশ্লিষ্ট রেয়াতি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ সুবিধায় ইতোমধ্যে অনেক হোটেল গড়ে ওঠায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজস্ব সুরক্ষার স্বার্থে এ খাতে শুল্ক কর অব্যাহতি চলমান রাখা অপ্রয়োজনীয় মর্মে প্রতীয়মান। তাই বিদ্যমান প্রজ্ঞাপনটি বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করছি।
বাড়ছে সব ধরনের টিস্যুর দাম
টিস্যুর মূসক হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে বাড়বে সব ধরনের টিস্যুর দাম। অর্থমন্ত্রী বলেন, কিচেন টাওয়েল (২৪-২৬ জিএসএম), টয়লেট টিস্যু (১৮ থেকে ২৪ জিএসএম), ন্যাপকিন টিস্যু (২০-২৪ জিএসএম), ফেসিয়াল টিস্যু, পকেট টিস্যু (১২-১৬ জিএসএম), হ্যান্ড টাওয়াল, পেপার টাওয়াল, ক্লিনিক্যাল বেড শিটের মূসক হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।