লামার পাহাড়ি জনপদে দৃশ্যমান যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত নানামুখী উন্নয়নের কারণে দুর্গম পাহাড়ি জনপদেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন আর দুর্গম মনে হয় না। বিশেষ করে উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে সরীসৃপের মতো নির্মিত শত শত কিলোমিটারের আঁকা-বাঁকা পিচঢালা মসৃণ পাহাড়ি সড়কগুলো সব অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। সড়কের পাশাপাশি বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট এক পাহাড়কে আরেক পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দুই-তিন দিনের গন্তব্যে এখন কয়েক ঘণ্টায় যাওয়া-আসা করা যায়। যা পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলোর কাছে স্বপ্নের মতো। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, দেখতে পিকআপের মতো যাত্রীবাহী চাঁদের গাড়ি, বাস, মাইক্রোবাস ও জিপ নিয়মিত চলাচল করে সড়কগুলোতে। পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যাও।
অনুসন্ধান নিয়ে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হিসেবে পরিচিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র পর উন্নয়নের গতি বেড়ে যায়। ১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্যাঞ্চলকে দেশের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকার তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বিগত ২৬ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প কারখানা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ অনেক খাতেই সরকার নানামুখী উন্নয়ন পদক্ষেপ নেয়।
স্থানীয়রা বলছেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামায়ও এমন চোখ ধাঁধানো সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে, স্বপ্নেও ভাবেননি তারা। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে এখন আর তারা অনেক খুশি। চুক্তির কতটুকু কী হলো সেটা নিয়েও এখন আর তাদের জানার আগ্রহ নেই। তাদের চোখ উন্নয়নের দিকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার যত উন্নতি হবে, তত জীবন মান উন্নত হবে বলে মনে করেন তারা।
সরেজমিনে,গত ২০,২১ ও ২২ ডিসেম্বর লামার রুপসী পাড়া ,সরই ও ফাইতং ইউনিয়নের ( পূর্ব শিলেরতোয়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি ও কৃষক ) আব্দুল মান্নান ও থুইলাচিং মার্মার সঙ্গে কথা হয়। প্রতিবেদককে তারা বলেন, কখনও আশাই করিনি মাতামুহুরী নদীর উপর শিলেরতুয়া রুপসী পাড়া গাডার ব্রীজ ও প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে বহুতল ভবন নির্মাণ -রোয়াজা পাড়া মৈরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী মোঃ এ কে আজাদ বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে তারা স্থানীয়দের স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কে তাদের সচেতন করার কাজ করছেন। কীভাবে কী করলে তারা স্বাস্থ্য সেবা পাবেন। এছাড়াও লামার সরই ইউনিয়ন ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র হয়েছে। প্রান্তিকের মানুষ স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ি মোহাম্মদ সেলিম জানান, যে জায়গায় আগে পায়ে হেটে যেতে দিন ফুরিয়ে যেত সেখানে এখন সড়ক পথে উপজেলা সদরে আধা ঘণ্টায় যাওয়া-আসা করা যায়। এমন উন্নত সড়ক ব্যবস্থা হবে তারা স্বপ্নেও ভাবেননি।
অসচ্ছল ও প্রান্তিক পরিবারের নারী উন্নয়নে গাভী পালন প্রকল্প, সুগারক্রপ চাষাবাদ জোরদারকরণ প্রকল্প, কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র হ্রাসকরণ প্রকল্প,রাবার চাষ, তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকদের দারিদ্র বিমোচন প্রকল্প, প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ, মিশ্র ফল চাষ, উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিকরণ প্রকল্পগুলো সরকারি -বেসরকারির অন্যতম।
#একনজরে বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এর আওতায় বাস্তবায়িত /বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কাজের বিবরণী:
উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন সাল:-২০০৮-২০০৯ ইং হইতে ২০২২-২০২৩ ইং অর্থ বৎসর। সমাপ্তকৃত কাজ:কাজের বিবরণ: ক্রমিক নং: ১-বিসি দ্বারা পাকা সড়ক উন্নয়ন মোট ৪টি(বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। উন্নয়নকৃত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২০.২৯০(কি:মি:)। ব্যায়িত অর্থ ২০০০.০০ (লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং:২-এইচবিবি দ্বারা সড়ক উন্নয়ন ১১ টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। উন্নয়নকৃত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৫৮.০০(কি:মি:)। ব্যায়িত অর্থ ৬৬০০.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :৩- পাকা সড়ক রক্ষনাবেক্ষণ(মেরামত) ২৫টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। উন্নয়নকৃত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৩৫.০০(কি:মি:)। ব্যায়িত অর্থ ২৮০০.০০(লক্ষ টাকা)।
ক্রমিক নং :৪-আরসিসি ব্রিজ /কালভার্ট নির্মাণ ৩১ টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। উন্নয়নকৃত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ০.৭২৩(কি:মি:)।ব্যায়িত অর্থ ৬১০০.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :৫-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ ৬৫ টি। ব্যায়িত অর্থ ৬৮২৬.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :৬-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন মেরামত ৫৩টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ৫৩০.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :৭-সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ ১৪ টি(বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। উন্নয়নকৃত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২.৩১০ (কি:মি:)।ব্যায়িত অর্থ ১৮০০.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :৮-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস নির্মাণ ১টি(বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ১৬১.০০(লক্ষ টাকা)।ক্রমিক নং :৯-ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ ৩ টি(বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ২৬৪.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :১০- ভূমিহীন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গৃহ নির্মাণ ২টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ২০.০০ (লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং:১১-মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণ ১ টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ৫৬.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং: ১২-সামাজিক অবকাঠামো (মসজিদ /মন্দির /কেয়াংও স্মশান)নির্মাণ /উন্নয়ন ৫ টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ৭০.০০(লক্ষ টাকা)।
ক্রমিক নং :১৩-হাট-বাজার নির্মাণ/উন্নয়ন ৪ টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ১০০.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :১৪- উপজেলা প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ ১টি(বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ৭১০.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :১৫-উপজেলা চেয়ারম্যান বাসভবন নির্মাণ ১টি(বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ১২৬.১৯(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং:১৬-উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসবভন নির্মাণ ১টি(বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ১২৬.১৯(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :১৭-পুকুর খনন ও সংস্কার ২টি(বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ৫৯.০০(লক্ষ টাকা)। ক্রমিক নং :১৮-বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী(এডিপি) ২১০টি (বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা)। ব্যায়িত অর্থ ১২৫০.০০(লক্ষ টাকা)।
সর্বমোট বাস্তবায়িত প্রকল্পের সংখ্যা – ৪৪৯ টি।
সর্বমোট ব্যায়িত অর্থ- ২৯৫,৯৮,০০,০০০/=(দুইশত পঁচানব্বই কোটি আটানব্বই লক্ষ টাকা)।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক খাতেও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে সরকার। এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, সংস্কার, শিক্ষা বৃত্তি প্রদান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন এবং পানি সম্প্রসারণ কার্যক্রম, সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ, হাটবাজার উন্নয়ন ও বনায়ন কার্যক্রম রয়েছে।
লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে বিগত ৫ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডঃ
#গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) ৯৬১ টি প্রকল্প, বরাদ্দের পরিমাণ ৫,৭৮,১৪,৫৭৬.০০ মে.টন চাল ও গম, গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) ১৩৩টি প্রকল্প,বরাদ্দের পরিমাণ ১০৭৮.৯২৩৭ মে.টন চাল ও গম,গ্রামীণ অবকাঠামো রংক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) ৬৬৯ টি প্রকল্প ,বরাদ্দের পরিমাণ ৬,৮৮,৫৯,০২৯ মে.টন ও চাল,এইচবিবি রাস্তা ১৩ কিলোমিটার,বরাদ্দের পরিমাণ ৬,৪৩,১০,০৮৬.০০ চাল ও গম,সেতু/কালভার্ট ২ টি, বরাদ্দের ১,৭১,১৮,৫৮৬.৭১৫ মে.টন চাল ও গম।
লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ গ্রামীণ জনপদ উন্নয়নে বড় অবদান রেখে যাচ্ছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মোঃ আবু হানিফ জানান, সারা দেশের ন্যায় বান্দরবানের লামা উপজেলায়ও চারিদিকে উন্নয়নের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। এর সফল সাধারণ মানুষ ভোগ করছে।
এক্ষেত্রে লামা উপজেলা পরিষদ এর চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তফা জামাল বলেন, অত্র অঞ্চলের আমাদের প্রিয় অভিভাবক, পার্বত্য রত্ম, বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির মহোদয় এর একান্ত প্রচেষ্টায় আমাদের লামা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায়ও শিক্ষা,স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ সার্বিকভাবে ব্যাপক দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে।