হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী :
‘তাল গাছ এক পায়ে দাড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে’, ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ/ ঐ আমাদের গাঁ, ঐ খানেতে বাস করে/কানা বগি’র ছাঁ,’ এসব ছড়া’র সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। তাল গাছের সাথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। শুধু ছড়াই নয়, এই তাল গাছ নিয়ে রয়েছে গান, নানা গল্প-উপ্যনাস।
বাস্তবে, প্রচন্ড গরমে কঁচি তালের শাঁস বা বীচি খাওয়ার মজাই আলাদা। এছাড়া তালের রস, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী তালের পিঠাসহ নানা পিঠা-পুলি ও বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের নাম শুনলেই জিভে পানি এসে যায়। সেইসাথে ‘তালের পাখা’ বা তাল গাছের পাতার পাখা, তাল পাতার বাশিঁ, তাল গাছে বাবুই পাখি’র বাসাসহ নানা পাখ-পাখালি’র শিহরণ জাগানো কলরব কথা বলে শেষ করা যাবে না।
কিন্তু এ আধুনিক যুগে এসে জলবায়ু পরিবর্তন সহ নানা বিবর্তনে গ্রাম বাংলার এ তাল গাছ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। সমাজে এ কথা প্রচলন রয়েছে যে, তাল গাছের বৃদ্ধি অনেক ধীর গতি বলে তালের চারা রোপন করে ওই গাছের তাল খাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। যার ফলে বর্তমানে ফোর-জি ইন্টারনেটের যুগে এ তাল গাছ রোপনে কারো কোন আগ্রহ নেই।
হাই ব্রীড যত ফলদ ও বনজ গাছ আছে সেসব গাছের চারা রোপন নিয়েই ব্যস্ত সবাই। কিন্তু এর ব্যতিক্রমি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। এখানে এই ফোর-জি গতির যুগেও ধীর গতিতে বেড়ে ওঠা তাল গাছকে দেখছে ভিন্ন ভাবে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিজস্ব পরিকল্পনায় ৬৪ জেলার প্রায় দু’লাখ তাল বীজ বপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১৯ অক্টোবর) দুপুরে রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কের নাইক্ষ্যংছড়ি পুরাতন স্টেশন এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে তাল বীজ বপনের উদ্বোধন করেন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ উপলক্ষে প্রধান সড়কে র্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ কামাল উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামীলীগ সদস্য সচিব মো: ইমরান, নারী নেত্রী ওজিফা খাতুন রুবি, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত রাজশাহী বিভাগের তানোরের কৃষক নুর মোহাম্মদ, বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক নেজাম উদ্দীন, ঈদগড়ে আল্লাহর দান বহুমুখী কৃষি ফার্মের পরিচালক রহিম উল্লাহ, রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত নাইক্ষ্যংছড়ির কৃষক মোজাফ্ফর আহামদ।
অনুষ্ঠানে নাইক্ষ্যংছড়ি প্রেসক্লাব সভাপতি শামীম ইকবাল চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার নয়ন, সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম কাজল, হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শিমুল কান্তি বড়ুয়া, সাইফুল ইসলাম, মুহিবুল ইসলাম, মোঃ নজরুল ইসলাম, দেবাশীষ ভট্টাচার্য, সেলিনা আক্তার কাজল উপস্থিত ছিলেন।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন-একটি তাল গাছ পরিবেশ বান্ধবের পাশাপাশি মাটির ভাঙ্গন রোধ করে, বিশেষ করে রাস্তার পাশের মাটি বর্ষা বা বন্যার পানিতে শত ভাঙ্গনের মুখেও রাস্তা ভাঙ্গনে রোধ করে তাল গাছের শিকড়।
এছাড়া তাল গাছে বিলুপ্ত প্রায় বাবুই পাখিসহ নানা প্রজাতির পাখি আস্তানা গড়ে উঠে। সব চেয়ে লাভের বিষয় হলে অনেকটা অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা এই তাল গাছ থেকে পাকা তালের পাশপাশি বর্তমানে অপরিপক্ক বা কাঁচা তালের বীচি বা শাঁসের ব্যাপক চাহিদা হয়ে উঠেছে।
একটি তাল গাছে যে পরিমানের তাল ফলন হয় তাতে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার তালের শাঁস বিক্রি করার পর আরো কয়েক হাজার টাকার পাকা তাল বিক্রি করা সম্ভব হয়।
আমাদের রামুর এক প্রশ্নের উত্তরে এই কৃষিবিদ বলেন, ৬৪ জেলা থেকে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে বীজ সংগ্রহ করে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বপন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে রাস্তার দু’পাশে, মসজিদ, মন্দিরসহ নানা ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় দু’লাখ বীজ বপণ করা হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে তাল গাবেষণা ইনষ্টিটিউট নেই। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি যেন নাইক্ষ্যংছড়িতেই একটি তাল গবেষণা ইনষ্টিটিউট স্থাপিত হয়।