খাবারের অভাবে এক বেলা খেয়ে দিন কাটাতে হলেও সরকারি সহায়তা নিতে নারাজ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দারা আগে জমিতে তাদের অধিকার চান।
“মনে হচ্ছে সাঁওতালদের দাবি এড়িয়ে ত্রাণের নামে সামান্য খাদ্য দিয়ে এবং গালভরা নানা আশ্বাস দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা এটি কোনোক্রমেই মেনে নেবে না। তারা চায় তাদের মূল দাবিগুলো অবিলম্বে মেনে নেওয়া হোক,” বলেছেন আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন।খবর বিডিনিউজের।
সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি তাদের দেওয়ার ঘোষণার পাশাপাশি সংঘর্ষের ঘটনায় সাঁওতালদের নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার, যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে উচ্ছেদসহ লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
মঙ্গলবার গোবিন্দাগঞ্জের জয়পুর ও মাদারপুর সাঁওতাল পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, উচ্ছেদ হওয়া দেড় শতাধিক পরিবার এখনও মাদারপুর চার্চের খোলা প্রাঙ্গণ ও চার্চের পরিত্যক্ত স্কুলভবনে বসবাস করছে। পল্লীর ছয়শ পরিবারেই দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট।
অর্থ-যোগানের ব্যবস্থা না থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছেন না তারা। কাজের সুযোগও নেই। অধিকাংশ পরিবারের লোকজনই শুধু রাতে খেয়ে দিন পার করছেন।
কথা বলতে গেলে ক্ষোভ ঝরে অনেকের কণ্ঠে।
মাদারপুর গ্রামের ইলিমা টুডু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কথা বলতে বলতে আমাদের গলা তো শুকিয়ে গেছে; কিন্তু কোনো কাজ তো হচ্ছে না।”
একই গ্রামের রুনা সরেন বলেন, “আগে হামারগুলার দাবি-দাওয়াগুলো পূরণ করেন, বাপ-দাদার জমি ফিরাইয়া দেন। তারপর অন্য কথা। হামার বাড়িঘর জ্বালাইয়া দিল, বাড়ির পালিত গরু-ছাগল পর্যন্ত লুট করে নিয়ে গেল; কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো বিচার হইল না।”
ইলিখা মার্ডি বলেন, বাপ-দাদার সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের ওই সম্পত্তি থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত করার পদক্ষেপ হিসেবেই বর্তমানে মিল কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জমিগুলো ঘেরাও করে ফেলছে, যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
অবিলম্বে কাঁটাতারের বেড়া তুলে ওই জমি তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ। এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে।
সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। সেই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।
এরপর চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন। চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওই জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর গুলিবর্ষণের এই ঘটনায় সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে। ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু মঙ্গলবার বলেছেন, ওই জমি সাঁওতালদের নয়।
“ভূমিদস্যুরা সাঁওতালদেরকে ব্যবহার করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাঁওতালদের দিয়ে দখল করিয়ে পরে নিজেদের দখলে নেওয়া।”
ওই জমি এখন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দুই গজ পর পর সিমেন্টের পিলার দিয়ে তাতে বাঁধা হচ্ছে কাঁটাতার। গত ৯ দিনে এক কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়েছে।
চিনিকল কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার রতন কুমার হালদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজেদের জমি রক্ষা করতে হলে বেড়া দিতে হবে। তা না হলে দখল হয়ে যায়। ”
তিন সাঁওতাল নিহত ও তাদের ঘরবাড়িতে হামলা-ভাংচুরের ঘটনায় প্রতিবাদের মধ্যে গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা যেতে সাঁওতাল পল্লীতে যান।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সেখানে এক সমাবেশে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তারা ‘আদিবাসীদের’ সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা নিয়ে এখানে এসেছেন। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন করা হবে। ভূমিহীনদের কৃষি জমি দেওয়া হবে। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ব্যবসা করার জন্য পুঁজি দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের জন্য এলাকায় আরও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
তালিকা করে ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে পদক্ষেপও নেওয়া হবে বলে তারা আশ্বাস দেন।
সাঁওতালদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
ঘটনার নেপথ্যে থেকে যারাই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা।
আওয়ামী লীগের তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সে সময় আদিবাসীদের বাপ-দাদার জমি ফেরতের বিষয়ে সবকিছু দেখে শুনে আইনগতভাবে সমাধানের আশ্বাস দেন।
তবে ওই সব আশ্বাসের কোনোটিরই এখনও বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাঁওতালদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে বলে জানান সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাসকে।
“সাঁওতালদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বা কোনো পক্ষ থেকেই এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দাবি অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপও গৃহীত হয়নি। ফলে সাঁওতাল পরিবারগুলো চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছে।”
সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দারা সোমবার প্রশাসনের দেওয়া ত্রাণ ফিরিয়ে দেন। তবে বেসরকারি ত্রাণ নিতে তাদের কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
যুব ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতি গাইবান্ধা জেলা শাখা মঙ্গলবার ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল পরিবারের মাঝে হাড়ি-পাতিল, থালা, গ্লাস, চামচ বিতরণ করে।
মাদারপুর চার্চ প্রাঙ্গণে যুব ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির ত্রাণ সামগ্রী নিতে আসা জ্যোৎস্না মুরমু বলেন, “সরকার ও এমপি ছাড়া অন্য সবার সাহায্য হামরা নিব।”
রোজিনা সরেনও একই সময় তাকে সমর্থন করেন।
উচ্ছেদ অভিযানের পেছনে স্থানীয় সাংসদ আবুল কালাম আজাদের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ সাঁওতালদের।
ত্রাণ বিতরণে আসা যুব ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা প্রতিভা সরকার ও কৃষক সমিতি গাইবান্ধা জেলা সভাপতি সুভাষ শাহ রায় বলেন, সাঁওতাল পল্লীর অধিবাসীদের উচ্ছেদের সময় বাড়ি-ঘরসহ হাড়ি-পাতিল, থালা, গ্লাস সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিভা বলেন, “তারা কলাপাতায় খাবার খাচ্ছে, রান্না করতে পারছে না। তাই আমরা হাড়ি পাতিল থালা গ্লাস বিতরণ করেছি।”
সাঁওতালরা এখন গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন বলে আদিবাসী ছাত্র ফেডারেশনের গোবিন্দগঞ্জ শাখার সাবেক সভাপতি রতন মারডি জানান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিনিকলের শ্রমিকরা সোমবার গোবিন্দগঞ্জে মানববন্ধন করে এবং ফার্মের কাটা এলাকায় সাপমারা ও কাটাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের যৌথ আয়োজনে আদিবাসী ও বাঙালি মুসলমানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে।
“ওই সভায় গোবিন্দগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ প্রধান অতিথি ছিলেন। এই মানববন্ধন ও সভায় আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। তাই সাঁওতাল পল্লীতে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
“এলাকায় পুলিশ দেখলেই সবাই সরে পড়ছে। কারণ ৬ নভেম্বর জমি থেকে উচ্ছেদের পর পুলিশ গোবিন্দগঞ্জ থানায় আমাদের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করেছে সেখানে সাড়ে তিনশ জনকে আসামি করা হয়। তাই সবাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছে।”
সংঘর্ষের ঘটনায় সাঁওতালদের ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছে পুলিশ। কিন্তু তিন সাঁওতাল নিহত ও আর অনেকে আহতের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
গ্রেপ্তার আতঙ্কের পাশাপাশি ফের পল্লীতে হামলার আশঙ্কাও করছেন সাঁওতালরা। এ শঙ্কায় রাতে পালা করে চলছে পাহারা।