ধর্ম ডেস্ক:
মাহে রমজানের নাজাত তথা ক্ষমার দশক চলছে এখন। এই শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করে নাজাত লাভের পথ তৈরি করা উচিত। শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করে সে অনুযায়ী ইবাদত করে অশেষ নেকি হাসিল করতে পারে মোমিন-মুসলমানরা। তাছাড়া শেষ দশকে এতেকাফ করেও অনেক পুণ্য লাভ করা যায়।
তবে শুধু ইবাদত-বন্দেগী ছাড়াও আমাদের আরো করণীয় রয়েছে। নিজে ইবাদত করার পাশাপাশি অন্যকে ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়া মানুষকে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা, অসৎ কাজের প্রতিরোধ করা উচিৎ। শুধু রমজান মাস নয়, অন্যান্য সময়েও এ কাজ করতে হবে এবং তা করা ফরজ।
সমাজের মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত ও শিক্ষাদান সত্ত্বেও সব মানুষ হেদায়েত গ্রহণ করবে না ও সৎ হবে না। কেননা, মানুষ ও জ্বিন শয়তান সমাজে বিরাজ করছে। তারা কখনও ভাল হয় না। তাই সমাজ সংশোধনের পরবর্তী কাজ হলো সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ। আর এটি না করলে সৎ ও ভাল মানুষকে দ্বীনের পথে টিকিয়ে রাখা যাবে না।
রমজানের রোজা ফরজ। কিন্তু অনেকেই এই ফরজ রোজা রাখতে চায় না। অনুরূপভাবে নামাজ, জাকাতসহ অন্যান্য ফরজ কাজগুলোও আদায় করতে চায় না। কেউ কেউ হারাম কাজ করে থাকে। যেমন- সুদ-ঘুষ খাওয়া, মদ পান, জেনা করা, জুয়া খেলা, ধোকা দেওয়া, ওজনে কম দেওয়া ইত্যাদি। শক্তি প্রয়োগ করে এসব বন্ধ করা উচিৎ।
রাষ্ট্র ও সমাজের এক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে। পবিত্র কোরআনে রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘তোমরা এমন জাতি বা দল, যাদেরকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সূরা আল ইমরান: ১১০)
এই আয়াতে মিল্লাতে ইসলামিয়ার সব ব্যক্তি ও সদস্যের জন্য সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর একটি অংশকে এই কাজে নিয়োগ করে উম্মাহর অবশিষ্ট সদস্যরা মুক্তি পেতে পারে। তবে শর্ত হলো, যদি এই কাজ দুটো সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়। একদল ঠিকভাবে কাজ আদায় করলে অন্যদের জন্য তা আর বাধ্যতামূলক থাকবে না।
এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা দরকার যারা ভাল কাজের দিকে মানুষকে ডাকবে, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ করবে। ( সূরা আল-ইমরান: ১০৪)
রাব্বুল আলামিন কোরআনে মোমিনের গুণাবলী উল্লেখ করে বলেছেন, ‘মোমিন পুরুষ ও নারীরা পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎ কাজের আদেশ করে, মন্দ কাজে বাধা দান করে, নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। তাদের ওপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন।’ (সূরা তওবা- ৭১)
এই আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ, নামাজ, জাকাত ও অন্যান্য আনুগত্যকে মোমিনের জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ দায়িত্ব কিভাবে পালন করা যাবে। এটি দুভাবে করা যায়। এক- ব্যক্তিগতভাবে, দুই- সামষ্টিকভাবে।
ব্যক্তিগতভাবে যে যেখানে ও যে অবস্থায় আছেন সে অবস্থাতেই যথাসাধ্য এ কাজ করার চেষ্টা করা উচিৎ। সামষ্টিক পর্যায়ে যাদের এই দায়িত্ব পালন করতে হবে তারা হলেন- পরিবার প্রধান, মসজিদের ইমাম, কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান। যেমন- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান, ক্লাব ও হাসপাতালের প্রধান, কোনো কমিটি ও সংস্থার প্রধান, প্রেসিডেন্ট বা চেয়ারম্যান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান, মন্ত্রী এবং বিভিন্ন বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান।
প্রত্যেককে নিজ নিজ পরিসর ও কর্মক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে। এর মধ্যে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন- ‘তোমরা জেনে রাখ, তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক এবং প্রত্যেককেই তার অধীনস্থ লোকদের সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে। সুতরাং যিনি নেতা এবং মানুষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাকে তার অধীনস্থ লোকদের সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে। পুরুষ বা পরিবার প্রধান তার পরিবারের লোকদের তত্ত্বাবধান ও কর্তৃত্ব করেন, সুতরাং তাকে পরিবারের অধীনস্থ লোকদের সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে। স্ত্রী হচ্ছেন নিজ স্বামীর ঘরের গৃহকর্রী ক এবং তার সন্তানের তত্ত্বাবধানকারী। তাই তাকে তাদের সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)
এই হাদিসে প্রত্যেক মুসলমানকে দায়িত্বশীল কর্তা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দাওয়াতে দ্বীনের পরই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ না করলে যথার্থ দায়িত্ব পালন করা হবে না।
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ বিষয়ে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন- ‘তোমাদের কেউ কোনো মন্দ কাজ দেখলে তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করবে, এতে সক্ষম না হলে মুখ দিয়ে প্রতিরোধ করবে এবং তাতে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। এতেও সক্ষম না হলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে এবং তাতেও দায়িত্ব মুক্ত হবে। তবে এটি খুবই দুর্বল ঈমান।’ (মুসলিম ও নাসাঈ)
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ না করলে পরকালে শাস্তিতো আছেই এমনকি দুনিয়াতেও আল্লাহ তাআলা তার শাস্তি দেবেন। হযরত হোজায়ফা বিন ইয়ামান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন- ‘আমার প্রাণ যার হাতে সেই আল্লাহর শপথ করে বলছি, হয় তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ করবে, না হয় শিগগিরই আল্লাহ তোমাদের ওপর নিজ আযাব পাঠাবেন। এরপর তোমরা তার কাছে দোয়া করবে। কিন্তু তিনি তোমাদের দোয়া কবুল করবেন না।’ (তিরমিজি)
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধের ফজিলতও রয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক বনি আদমের শরীরে ৩৬০টি জোড়া আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহু আকবার বলে, আলহামদু বলে, গুনাহ মাফ চায়, মানুষের চলার পথের পথ থেকে পাথর, কাঁটা কিংবা হাড় সরায়, সৎ কাজের আদেশ করে, মন্দ কাজে বাধা দেয় এবং এর সংখ্যা ৩৬০ হয় তাহলে সেদিন সন্ধ্যায় তার অবস্থা হবে এমন ব্যক্তির মতো যে নিজেকে দোজখের আগুন থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।’ (মুসলিম)
বস্তুতঃ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ করলে সমাজেও এর যথেষ্ট সুফল পাওয়া যাবে। সমাজ থেকে অন্যায় অসত্যের মূলোৎপাটন হবে এবং কল্যাণ ও মঙ্গলের ফল্গুধারা প্রবাহিত হবে। সমাজ থেকে অপরাধ, সন্ত্রাস, হাইজ্যাক, রাহাজানি, হানাহানি, মারামারি ও অশান্তি দূর হবে। পরিণতিতে দেশ একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এর সুফল ভোগ করবে গণমানুষ। রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রত্যেককে সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেওয়ার তাওফিক দান করুন। -আমিন।
সূত্র: রাইজিংবিডি।