নীতিশ বড়ুয়াঃ
বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপ-সংঘরাজ, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ও সমাজ সেবায় একুশে পদক পাওয়া পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বলেছেন, সংসার জীবন প্যাঁচঘরের মতো অত্যন্ত জটিল এবং চক্রময়। এই জটিলতা ও জীবন চক্রকে অত্যন্ত ধৈর্য’র সাথে অতিক্রম করে সঠিক লক্ষে পৌঁছাতে হয়। ধৈর্য হারালে চলবে না। আমরা বাংলাদেশি হিসেবে একই অঞ্চলভূক্ত মানুষ। আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সুন্দর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই।
শুক্রবার ২২ এপ্রিল দিন ব্যাপী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রামুর উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে অনুষ্ঠিত স্বর্গপুরী উৎসব ও বৌদ্ধ মহাসম্মেলনের আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলে সারি সারি সাজানো বাগানে ফেলেছে আলোর ছটা। এ আবহে কেউ গাইছে আবার কেউ নৃত্যরত। এখানে কোনো রকম দুঃখ কাউকে যেন স্পর্শ করতে পারছে না। এই হলো স্বর্গের কল্পিত রূপ। কোনো লোক চাইলেই বহু আকাঙ্খিত এ স্বর্গে পৌঁছাতে পারে না। সংসার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে জীবদ্দশার ভালো কর্মের প্রভাবে একপর্যায়ে মানুষ স্বর্গে আরোহণ করতে সক্ষম হয়, আবার পুনঃজন্ম গ্রহণ করে মর্ত্যলোকে ফিরে আসে। এমনি ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে প্রাণীকুল এক সময় নির্বাণ সুখ লাভ করে।
এ ধারণা থেকেই কক্সবাজারের রামু উপজেলার উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে কৃত্রিম স্বর্গ তৈরি করে দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালায় স্বর্গপুরী উৎসব ও ব্যুহচক্র মেলা উদযাপন হয়ে আসছে।
ভোরে প্রভাতফেরি সহকারে বুদ্ধপূজা, সকালে ভিক্ষুসংঘকে পিন্ডদান, জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্টপরিস্কারসহ মহা সংঘদান, ধর্ম দেশনা, অতিথি ভোজন, দুপুরে স্বর্গপুরী উদ্বোধন, দলীয় নৃত্য, বিকেলে ব্যুহচক্র প্রদক্ষিণ ও আলোচনা সভা, সন্ধ্যায় বিহারের প্রয়াত অধ্যক্ষ প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র নির্বাণ সুখ ও দেশ-জাতি এবং বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে দিনব্যাপী স্বর্গপুরী উৎসব সম্পন্ন করা হয়। রাতে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে।
সম্প্রীতির তীর্থভূমি রামুর উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের স্বর্গপুরী উৎসব হাজারো বৌদ্ধ নারী-পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের লোকজনের অংশ গ্রহণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয় এটি।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ, সমাজ সেবায় একুশে পদক প্রাাপ্ত পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্বর্গপুরী উৎসব বিহারের সাবেক অধ্যক্ষ প্রয়াত প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র প্রতি উৎসর্গ করা হয়।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু’র সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ভারতের বোম্বে অজন্তা বৌদ্ধ বিহারের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ধর্মরত্ন মহাথের। এতে ধর্মদেশনা করেন, সম্প্রতি মায়ানমার সরকার কর্তৃক ‘অগ্গমহাসদ্ধম্মজোতিকাধ্জ’ উপাধিতে ভুষিত ভদন্ত বসুমিত্র মহাথের, বিজয় রক্ষিত মহাথের, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র ও একশ ফুট সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক করুণাশ্রী থের, রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ জ্যোতিসেন থের, বিবেকারাম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শীলমিত্র থের প্রমুখ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন রামু থানার অফিসার ইনচার্জ প্রভাষ চন্দ্র ধর, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, বিটিভি কক্সবাজার সংবাদ প্রতিনিধি জাহেদ সরওয়ার সোহেল, রামু প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, মাছরাঙ্গা টিভি’র কক্সবাজার প্রতিনিধি সুনীল বড়ুয়া।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, বিহার পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া। অনুষ্ঠানে পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন উদযাপন পরিষদের উপদেষ্ঠা কল্যাণ বড়ুয়া।
প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের জানান, ১৭৬৭ সনে রাখাইন সম্প্রদায় বৌদ্ধ বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। কালের বিবর্তনে রাখাইন সম্প্রদায় এলাকা থেকে চলে গেলে এ অঞ্চলে বসবাসকারী বড়ুয়া বৌদ্ধরা বিহার রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন। অনেক বছর ধরে গ্রামবাসী প্রয়াত বিহারাধ্যক্ষ প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র পরিচালনায় বিহার প্রাঙ্গনে ব্যুহচক্র মেলার আয়োজন করে আসছিল। তিনি ১৯৮২ সন থেকে ওই ব্যুহচক্র মেলাকে স্বর্গপুরী নামের উৎসবে রূপান্তর করেন। এরপর প্রতিবছর ব্যুহচক্র মেলা ও স্বর্গপুরী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এ বছর ৩১তম স্বর্গপুরী উৎসবে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা, বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, চট্টগ্রামের পটিয়া, রাউজান, রাঙ্গুনীয়া ও খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বৌদ্ধদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী যোগ দিয়েছেন।
বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারেও সুষ্ঠু-সুন্দর আয়োজনে যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় স্বর্গপুরী উৎসব সম্পন্ন হয়েছে। দিনব্যাপী এ উৎসব এখন আর বৌদ্ধদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। সকল ধর্মালম্বী লোকজনের অংশ গ্রহণে উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের স্বর্গপুরী উৎসব বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উৎসবে রূপ নিয়েছে। শতাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রামনের অংশগ্রহণে বহুগুণ মর্যাদায় বৃদ্ধি পেয়েছে এ উৎসব।
এদিকে উৎসব আয়োজনে সহযোগিতার জন্য স্থানীয় প্রশাসনসহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বিহার কর্তৃপক্ষ।