অনলাইন ডেস্কঃ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্দেশ সত্ত্বেও পুলিশের দাবি পূরণ না হওয়ায় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এসব দাবির বিষয়ে তিনি সম্মতি দেয়ার পরও কেন পূরণ হয়নি, তা তাকে অতিসত্ত্বর জানাতেও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
রোববার (৫ জানুয়ারি) রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে বার্ষিক প্যারেডের মধ্য দিয়ে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর কল্যাণ সভায় সরকারপ্রধান এ অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
ওই সভার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত দুই পুলিশ সপ্তাহে যে দাবি উত্থাপিত হয়েছে, তার প্রায় সবই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও আশ্বাস সত্ত্বেও। পুরনো এ দাবিগুলো ফের প্রধানমন্ত্রীর সামনে উত্থাপন করা হলে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এসব বিষয়ে তিনি সম্মতি দেয়ার পরও কেন তা বাস্তবায়ন হয়নি তা তাকে অতিসত্ত্বর জানাতেও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সভায় পুলিশ তাদের পুরনো দাবিগুলো তুলে ধরে এবারও। পুলিশের পক্ষ থেকে কনস্টেবল থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে কথা বলেন।
একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা দাবির বিষয় তুলে ধরে জাগো নিউজকে বলেন, নিম্ন-পদস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিভিন্ন ট্রেড যেমন- টেলিফোন, বিউগল, নার্সিং, ড্রাইভিং, ক্লিনার ইত্যাদি ভাতা যা ট্রেডভেদে ১৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত, সেসব ক্ষেত্রে বর্তমান বেতন কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ানোর দাবি তোলে পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান বেতন কাঠামোর পূর্ববর্তী কাঠামো অর্থাৎ ২০১৫ সালের কাঠামো অনুযায়ী এই ভাতা বাড়ানো যেতে পারে যা ট্রেডভেদে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
অন্যান্য সব সরকারি বিভাগের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে সব শ্রেণির কর্মকর্তা কর্মচারীর জন্য ৩০ শতাংশ প্রশিক্ষণ ভাতা চালু রয়েছে। পুলিশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহের মধ্যে কেবল বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি (সারদা) এবং বাংলাদেশ পুলিশ স্টাফ কলেজে (মিরপুর) কর্মরত এএসপি হতে তদুর্দ্ধ কর্মকর্তাদের জন্য ৩০ শতাংশ ভাতা চালু হয়েছে। অন্যান্য সরকারি দফতরের সাথে এক্ষেত্রে সমতায়নের দাবি তোলা হয় সভায়।
এ দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতেও একই সুবিধা দেয়া যৌক্তিক। তিনি এ বিষয়ে সম্মতি দেন।
পুলিশসহ কয়েকটি সরকারি সংস্থা পাচারকৃত বা চোরাই বা অবৈধ মালামাল উদ্ধার করে থাকে। অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা তাদের উদ্ধারকৃত মালামালের মূল্যের ওপর একটি প্রণোদনা পেলেও পুলিশ এ ধরনের কোনো সুবিধা পায় না। তাই পুলিশ উদ্ধারকৃত মালামালের ন্যূনতম ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা হিসেবে তাদেরকে দিতে দাবি তোলে।
তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো সম্মতি মেলেনি।
অন্যান্য বিভাগের সরকারি কমকর্তা কর্মচারীরা নানা ধরনের ছুটি মিলিয়ে বছরে প্রায় ১২০ দিন ছুটি ভোগ করে থাকেন। কাজের ধরন ও চাপের কারণে পুলিশ সদস্যরা কখনোই এই ছুটি ভোগ করতে পারেন না। তাই এই সময়টি স্পষ্টতই কর্মকাল বিধায় পুলিশ সদস্যদের কমপক্ষে ষাট দিন বা দুই মাসের মূল বেতনের সম-পরিমাণ আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার দাবি তোলা হয় সভায়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী এক মাসের মূল বেতনের সম-পরিমাণ আর্থিক সুবিধা দিতে সম্মত হন।
পুলিশ সদস্যরা নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় কাজে থাকেন বলে চাকরি-পরবর্তী সময়ে অন্যরা যখন ভিন্ন কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন, পুলিশ সদস্যরা নানা প্রকার অসুস্থতায় ভোগেন। এ সময় তাদের জীবন ও জীবিকা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। তাই পুলিশ সদস্যরা তাদের জন্য দুই জন হিসাবে ধরে আজীবন রেশন সুবিধার দাবি তোলেন।
এ দাবিটিকে অত্যন্ত যৌক্তিক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তা বাস্তবায়নে সম্মতি দেন।
অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান বা বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরা ছুটিতে গিয়ে মারা গেলেও এককালীন আট লাখ টাকা পান; পুলিশের একজন সদস্য জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হলেও পান পাঁচ লাখ টাকা। অন্যান্য সরকারি দফতরের একজন সদস্য সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো উপায়ে আহত হলে যেখানে চার লাখ টাকা পান, সেখানে পুলিশের একজন সদস্য সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে গুরুতর আহত হলেও পান এক লাখ টাকা। এ বিষয়ে সমতায়নের জন্য বিগত কয়েকটি পুলিশ তোলা দাবিটি পুনরুত্থাপন করা হয়।
এ দাবির বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অন্য প্রশাসনের কেউ আহত হলে ভাতা পান। পুলিশের ক্ষেত্রেও আহত হলে ভাতা দেয়ার কথা ছিল। পুলিশ কেন পাচ্ছে না এটা আমার বুঝে আসছে না। আমার তো মনে হয় পুলিশকে আরও ভালোভাবে দেয়া উচিত। কারণ তারা প্রতিদিন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যায়।
সাত কার্য দিবসের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করার নির্দেশ দেন তিনি।
এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী পুলিশের আবাসন সমস্যার কথা আঁচ করতে পেরে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পূর্বপাশে গণপূর্তের যে আবাসিক দালানগুলো উঠছে, সেখানে পুলিশ সদস্যদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আবাসন বরাদ্দের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী পুলিশ সপ্তাহে পদকপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সবসময় পুলিশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর একটা আন্তরিকতা ছিল। তিনি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন, তখন পুলিশের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি নিজেও বলতে পারি যে, ক্ষমতায় আসার পর পুলিশের কিন্তু দাবি করতে হয়নি। বরং পুলিশের সমস্যা কী কী তা খুঁজে বের করে সমাধান করার চেষ্টা করেছি। আগে পুলিশ বেতনের মাত্র ২০ শতাংশ রেশন পেতো। সেই রেশন আমরা শতভাগ করে দিয়েছি। টিফিন ভাতা-ঝুঁকিভাতা সবই আমি করেছি। যখন পুলিশকে ঝুঁকিভাতা দিতে চাইলাম তখন সবাই বললো, সবাইকে ঝুঁকিভাতা দিতে হবে। টিফিন ভাতা দিতেও শুনতে হয়েছে সবাইকে দিতে হবে। অর্থাৎ পুলিশের জন্য আলাদা করে কিছু করতে চাইলেই সবার জন্য করার দাবি ওঠে। কিন্তু একটা বিষয় দেখেছি যে, সবাই যখন নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় করে চলে যায়, তখন পুলিশের কথা ভুলে যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে পুলিশের বদনাম ছিল। কিন্তু এবার ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো পত্রিকা কিছু লিখতে পারেনি।
সরকারপ্রধান বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে যে দাবিগুলো তোলা হয়েছে, সেগুলো গত বছরই তোলা হয়েছিল। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছিল এবং আমার অফিস থেকে সেটা বাস্তবায়নের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো কেন বাস্তবায়ন করা হয়নি, ঝুলে আছে তা আমি জানি না। এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রসচিব বসে আছেন, আমি তাদের কাছে জানতে চাই। তারাই বলবেন, কেন এগুলো পেন্ডিং রয়ে গেছে।
‘অনেক বেতন বাড়ানো হয়েছে। সেজন্য ভাতার ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল যে ২০১৫ সালের বেতনের সাথে অঙ্কের পরিমাণে হবে, পার্সেন্ট হারে হবে না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি যে, ১৯৮৫ সালের টাকার মান বা টাকার ভাতা, মানে ১৫ টাকা ৩০ টাকা। আসলে তো এখন ১৫ টাকায় এক কাপ চাও পাওয়া যায় না। এই বিষয়গুলি কেন আমি জানি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলবো এইগুলি সমন্বয় ও যুগোপযোগী করতে। আমার অফিস থেকে আমি পাঠিয়েছিলাম। এর অনেকগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। নিচের লেভেল থেকে কিছু গেলে তা যদি আটকে দেয়া হয় তাহলে সংশ্লিষ্টরা সংক্ষুব্ধ হয়। এগুলো কৌশলে বের করে আনাই তো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দাবি করলে তো কেউ কম করে না। অন্তত অর্ধেক যেন পায় সেজন্য ডাবল দাবি করে। পুলিশের পক্ষ থেকে যে দাবিটা করা হয়েছে তাতে হিসাবে বাজেট থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত লাগবে। আমরা এখন অর্থবছরের মাঝামাঝি আছি। আগামী অর্থবছরের আগে পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তবে যৌক্তিকভাবে যতোটা করা যায় আমরা করবো।
দাবি-দাওয়া তুলে ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত কল্যাণ সভায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিগত বছরে নানা ক্ষেত্রে পুলিশের সাফল্য তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি পেশাগত সেবার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে পুলিশের জন্য কিছু যৌক্তিক দাবিও তুলে ধরা হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
সূত্রঃ জাগোনিউজ