প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু :
বৌদ্ধ ধর্মে অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমার বিশেষত্ব অত্যন্ত বেশি। বৌদ্ধ সম্প্রদায় দিনগুলোকে ধর্মীয় মর্যাদায় পালন করে থাকেন। যেমন অষ্টশীল বা উপোসথ শীল পালন করা, দান করা, ভাবনা করা, প্রাণীহত্যা না করা ও সামাজিক অনুষ্ঠান বিবাহ উৎসব পালন না করা ইত্যাদি বিধি-বিধান মানা হয়।
আবার বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে বিচরণ করলে দেখা যাবে বৌদ্ধদের বৃহত্তর প্রায় সকল ধর্মীয় উৎসব পূর্ণিমা কেন্দ্রিক। বুদ্ধ পূর্ণিমা, ভাদ্র পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, ফাল্গুনী পূর্ণিমা ইত্যাদি ঘটনাবহুল পূর্ণিমা গুলো পরিপূর্ণ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে বৌদ্ধরা পালন করে থাকেন।
পূর্ণিমাগুলোর বিশেষত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি পূর্ণিমার সাথে একাকার হয়ে আছে বুদ্ধের জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া এক একটা কালজয়ী ঘটনা। মূলত বৌদ্ধরা পূর্ণিমা তিথিগুলো পালনের মাধ্যমে মহাকারুণিক বুদ্ধের উদ্দেশ্যে স্মৃতি চারণ করে থাকেন।
তেমনি মাঘী পূর্ণিমা ও স্মৃতি বিজড়িত একটি অনন্য পূর্ণিমা। মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধের জীবনে যে ঘটনা ঘটেছিল তা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
তথাগত বুদ্ধের আয়ু সংস্কার :
তথাগত বুদ্ধ কর্তৃক স্বীয় পরমায়ু সংস্কার শুভ মাঘী পূর্ণিমার একটি অত্যুজ্জল ঘটনা। ধর্মীয় ভাষায় আয়ু সংস্কার বলা হলে ও মূলত এই কথার মাধ্যমে আয়ু বিসর্জন দেবার ভাব ফুটে উঠেছে। বুদ্ধের মতে সংসারে কে কতদিন বাঁচবে, কোন রোগ কখন মানুষকে পেয়ে বসে, ত্রিকাল-ত্রিযামের মধ্যে কখন কার মৃত্যু হবে, মৃতদেহটি কোথায় নিক্ষেপ বা কবরস্থ করা হবে এবং মৃত্যুর পরে স্বর্গ-নরক কে কোথায় গিয়ে উৎপন্ন হবে এই পাঁচটি গভীর রহস্য কেউ আগে থেকে নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। বলতে পারে না বলেই তো মানুষ প্রস্তুতি নিয়ে মরতে পারেন না। এমনকি বিজ্ঞানের চরম অগ্রগতির এই যুগে বিজ্ঞানের পক্ষে ও তা সম্ভব নয়।
সাধারণ মানুষ ও বিজ্ঞানের সাথে সর্বজ্ঞ বুদ্ধের জ্ঞানের পরিধি কখনো তুলনার যোগ্য নয়। আমার এই উক্তির সাথে কারো দ্বিমত থাকলে তাকে প্রথমে বুদ্ধ সম্পর্কে গভীর গবেষণা করতে হবে। যেমন করেছিলেন মহাবিজ্ঞানী আইন স্টাইন, স্যার হরিসিং গৌর, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে. আব্দুল কালাম, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরু, বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম, ইতিহাসবিদ ঈশানচন্দ্র ঘোষ, নাগার্জুন, মহাভারতের সংবিধান রচয়িতা বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকর, বিজ্ঞানী কাল মার্কস প্রমূখ বিশ্ববিখ্যাত মনীষীগণ।
বুদ্ধ সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী এবং ত্রিকাল দর্শী ছিলেন। তাই তিনি উপরোক্ত পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলতে পারতেন। বুদ্ধবাক্য কখনো মিথ্যা হয় না। বুদ্ধগণ যা অধিষ্ঠান করেন তা সেই মত সম্পন্ন হয়ে থাকে। বুদ্ধ বৈশালীর চাপাল চৈত্যে অবস্থান করছিলেন। মাররাজা বুদ্ধকে পরিনির্বাণ লাভের জন্য প্রার্থনা জানালেন। বুদ্ধ মারকে বুঝালেন এখনো তাঁর ভিক্ষু-ভিক্ষুনী, নিপুন-নিপুনা, বিনীত-বিনীতা, বিশারদ-বিশারদা, বহুশ্রুত-বহুশ্রুতা, ধর্মধারী-ধর্মধারিনী, ধর্মাচারী-ধর্মাচারিনী, যথাধর্ম পালনকারী-যথাধর্ম পালনকারিনী এবং পাপ-প্রতিহারক ধর্মদেশনা করতে সমর্থ হয় নি। তারা এই আর্য্য ধর্ম পালনে যোগ্য না হওয়া পর্যন্ত তিনি পরিনির্বাপিত হবেন না।
তাঁর গৃহি উপাসক-উপাসিকাগণ বিনীত-বিনীতা, ধর্মাচারী-ধর্মাচারিনী, কর্তব্যপরায়ন-কর্তব্যপরায়না না হওয়া পর্যন্ত তিনি পরিনির্বাপিত হবেন না। কিন্তু না ! পাপমতি মার সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য সিদ্ধান্তে অটল রইল। পাপমতি মার ভাল করে বুঝতে পেরেছিল যে বুদ্ধ তার প্রার্থনা রাখবেন। কেননা এই পর্যন্ত পাপমতি মার বুদ্ধকে তিনবার প্রার্থনা করেছে। তিনবারের অধিক বুদ্ধ না বলবেন না। হলও তাই।
পাপমতি মারের বিনীত প্রার্থনা – “হে তথাগত, আপনার ভিক্ষু-ভিক্ষুনী, শ্রাবক-শ্রাবিকা, উপাসক-উপাসিকা আর্য্যমার্গ লাভে সুনিপুন, বিনীত, বিশারদ, বহুশ্রুত, ধর্মাচারী, যথাধর্ম পালনকারী এবং জনসমাজে সরল ব্যাখাসহ পাপ সংহারী ধর্মদেশনা করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রভূ ভগবান, এখন আপনি পরিনির্বাপিত হউন।”
ক্ষনিক পূর্বে বুদ্ধ বাক্যালাপে প্রধান সেবক আনন্দ স্থবির ভান্তেকে বলেছিলেন- “হে আনন্দ, রমনীয় বৈশালী, রমনীয় উদেন-চৈত্য, রমনীয় গৌতমক চৈত্য, রমনীয় সত্তম্ব চৈত্য, রমনীয় বহুপুত্র চৈত্য, রমনীয় আনন্দ চৈত্য, রমনীয় চাপাল চৈত্য।” “হে আনন্দ, যার চারি ঋদ্ধিপাদ ভাবিত, বর্দ্ধিত বহুলীকৃত, রথগতি সদৃশ অনর্গল অভ্যস্থ, ব্যস্ত ভূমি সদৃশ সুপ্রতিষ্ঠিত, অধিষ্ঠিত, পরিচিত্ত, সম্যক নিষ্পাদিত হয়েছে, তিনি ইচ্ছা করলে কল্পকাল অথবা অবশিষ্ট কল্প অবস্থান করতে পারেন।”
“হে আনন্দ, তথাগতের চারিঋদ্ধিপাদ ভাবিত, বহুলীকৃত, রথগতি সদৃশ অনর্গল অভ্যস্থ, বাস্ত-ভূমি সদৃশ সুপ্রতিষ্ঠিত, অধিষ্ঠিত, পরিচিত্ত ও সম্যক নিষ্পাদিত হয়েছে। আনন্দ, সেজন্য তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল অথবা অবশিষ্ট কল্প অবস্থান করতে পারেন।”
এত প্রাঞ্জল ভাষার ঈঙ্গিত আনন্দ স্থবির আচ করতে পারলেন না। তাই তিনি বলতে পারলেন না- প্রভূ সুগত, বহুজনের হিত এবং সুখের জন্য জীবগণের প্রতি অনুকম্পাবশত, দেব-মানবের হিতার্থে আপনি কল্পকাল অবস্থান করুন। কারণ তিনি তখন মারকর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন অর্থাৎ পাপমতি মার ভয়ানক রূপ দেখিয়ে ভান্তে আনন্দ স্থবিরকে বুদ্ধের কথার তাৎপর্য বুঝার মত সুযোগ দেয়নি। একে একে তিনবার বলার পর ও বুঝতে না পারায় বুদ্ধ আনন্দ স্থবিরকে বললেন- “আনন্দ, এখন তুমি যথোচ্ছিত স্থানে যেতে পার।” “সাধু ভন্তে” বলে বুদ্ধসেবক আনন্দ বুদ্ধকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ পূর্বক নিকটস্থ একটি বৃক্ষমূলে গিয়ে বসলেন।
তিনি যাওয়ার সাথে সাথে ওতপেতে থাকা পাপমতি মার এসে বুদ্ধকে পরিনির্বাপিত হওয়ার প্রার্থনা করেছিলেন। বুদ্ধ বললেন- “হে পাপমতি মার, তুমি এখন নিশ্চেষ্ট হও, অচিরেই তথাগতের পরিনির্বাণ হবে। আজ হতে তিনমাস পরে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা দিনে তথাগত পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হবেন।”
বুদ্ধ এবার স্মৃতি ও জ্ঞান যোগে অধিষ্ঠান করে বললেন, “এখন হতে তিনমাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত আমার প্রাণ বায়ু চলতে থাকুক, অতপর নিরুদ্ধ হউক।” সাথে সাথে শুরু হল ভীষন লোমহর্ষকর ভূমিকম্প, দেব দুন্দুভি অর্থাৎ দেব গর্জন, অকাল বিদ্যুৎ, ঘন বৃষ্টি। সেদিন ছিল শুভ মাঘী পূর্ণিমা। এই অবিস্মরণীয় ঘটনাকে স্মৃতিতে চিরভাস্বর করে রাখার জন্য বৌদ্ধরা যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় ভাবগম্ভীর পরিবেশে প্রতি বছর শুভ মাঘী পূর্ণিমা পালন করে থাকেন।
শুভ মাঘী পূর্ণিমার এই শুভসন্ধিক্ষণে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলের প্রতি মৈত্রীসিক্ত শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এবং বাংলাদেশের শ্রীবৃদ্ধিসহ বিশ্বশান্তি কামনা করছি।
“জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।”