বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশংসা করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা, চীন, জার্মানসহ বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রিত বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। তবে আমন্ত্রিত বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে এখনো ভোট নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি কনওয়েলথের প্রতিনিধিদল।
এছাড়া, নিজ উদ্যোগে ভোট দেখতে বাংলাদেশে আসা যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল এখন পর্যন্ত ভোট নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ জানায়নি।
রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল থেকে ঢাকায় এবং এর আশপাশের এলাকায় ভোট পর্যবেক্ষণ করেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। কেন্দ্র কেন্দ্রে ভোট পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষক। বাংলাদেশের ভোটের পরিবেশ নিয়ে ইতিবাচক অবস্থানের জানান দেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই।
আট ঘণ্টার ভোট শেষে এ দিন সন্ধ্যায় সরকারের আয়োজনে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণে শুরু হয় সংবাদ সম্মেলন। ফিলিস্তিন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্কটল্যান্ড, নাইজেরিয়া, গাম্বিয়া এবং ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থাসহ (ওআইসি) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যবেক্ষক সারাদিন কেমন ভোট দেখলেন, তা সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সদ্য শেষ হওয়া বছরের পুরোটা সময়জুড়ে বেশ সরব অবস্থানে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভিসানীতি প্রয়োগের পাশাপাশি বারবার বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে ওয়াশিংটন। তবে শেষ সময়ে এসে অনেকটাই চুপ হয়ে গেছে পুরো বছর বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অব্যাহতভাবে কথা বলা যুক্তরাষ্ট্র।
সরকারের আমন্ত্রণে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন মার্কিন পর্যবেক্ষক এবং দেশটির কংগ্রেসের সাবেক সদস্য জিম বেটস ও আমেরিকান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিসের প্রধান নির্বাহী আলেক্সান্ডার গ্রে। ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট পর্যবেক্ষণ করেছেন এই দুই পর্যবেক্ষক। দিনশেষে বাংলাদেশের ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
মার্কিন সাবেক কংগ্রেস সদস্য জিম বেটস বলেন, বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে ভোট হয়। আমি যেটা পেয়েছি… এখানে খুব শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। আমার চোখে আমি যেটা দেখেছি, সেটি হচ্ছে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এমন একটি নির্বাচন যেটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালনা করা হয়েছে। ভোটারদের মধ্যেও অনেক উৎসাহ ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষক আলেক্সান্ডার গ্রে বলেন, এখানকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ভোটগ্রহণ দেখে আমি ও আমার সহকর্মী সম্মানিত বোধ করছি। আমরা যেসব কেন্দ্রে গিয়েছি, সেখানে পেশাদারিত্বের উচ্চমান দেখেছি। নির্বাচন কমিশনকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে দেখেছি।
বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে ভোট দেখতে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল আইআরআই ও এনডিআই। রোববার দিনভর ভোট পর্যবেক্ষণ করেছে নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশে আসা ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি। তবে, ভোট সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নিজেদের কোনো পর্যবেক্ষণ জানায়নি তারা। ধারণা করা হচ্ছে, হয়ত খুব শিগগিরই নিজেদের অবস্থান জানাবে আইআরআই ও এনডিআই। অবশ্য ছয় থেকে আট সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থান করার কথা রয়েছে এ প্রতিনিধিদলের পাঁচ পর্যবেক্ষকের।
ভোট দেখতে আমন্ত্রিত রাশিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার অ্যান্দ্রে ওয়াই শুটব বলেন, আমি বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। খুব দারুণ নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছে। নির্বাচন স্বচ্ছ, উন্মুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে হয়েছে। ভোটের পরিবেশে নিরাপত্তা ছিল, এটা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। কোনো বিষয়ে কোনো তথ্যের অভাব ছিল না। গণমাধ্যমকর্মীরা স্বাধীনভাবে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন।
কানাডার সংসদ সদস্য চন্দ্রকান্ত আরিয়া বলেন, সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অবাধ ও সম্পূর্ণ সুযোগ থাকার বিষয় আমরা খতিয়ে দেখেছি ও নিশ্চিত হয়েছি। অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটারদের কাছে প্রচারণার সুযোগ ছিল কি না, আমরা সেটিও দেখেছি। কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই ভোটার ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি আমি দেখেছি।
বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে এক প্রশ্নে আরিয়া বলেন, ভোট বর্জন করা কোনো রাজনৈতিক দলের কৌশলগত সিদ্ধান্ত, সেটি তারা নিজেদের স্বার্থে করে থাকে। তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে মন্তব্য করা আমাদের কাজ নয়।
দক্ষিণ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাজাকা বলেন, ভোটের আগে সহিংসতার যে চিত্র ছিল, ভোটের দিন তার কিছুই দেখিনি। গণতন্ত্রের প্রতি শুদ্ধা জানিয়ে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চমৎকার। এই দিনটা আমি উপভোগ করেছি। ভোট কেন্দ্রগুলোতে নারী ও পুরুষ ভোটাররা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তাদের প্রার্থীদের বেছে নিতে যেভাবে ভোট দিয়েছে, তা দেখার মতো ছিল। ভোট শেষে ভোটারদের আঙুলে কালি দেওয়া এবং ভোটার তালিকায় ভোটারদের ছবি আমাকে মুগ্ধ করেছে।
তিনি বলেন, শুধু তাই নয় ভোটের প্রক্রিয়া ছিল খুবই দুর্দান্ত, যা দেখে আমি অবাক হয়েছি। এই ভোটে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল।
ফিলিস্তিনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাশিম কুহাইল বলেন, ভোট শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া ভোটের পরিবেশও খুব ভালো ছিল। নাগরিকদের ভোটদান প্রক্রিয়াও খুব সহজ ছিল।
নাইজেরিয়ার সিনেটর প্যাট্রিক সি বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। স্থানীয় লোকজনকে উৎসাহের সঙ্গে ভোট দিতে দেখেছেন। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে।
স্কটিশ সংসদ সদস্য মার্টিন ডে বলেন, ভোটের প্রক্রিয়া দেখেছি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ভোট হয়েছে কিন্তু ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।
ওআইসির পর্যবেক্ষকদের প্রধান সাকির মাহমুদ বলেন, ওআইসির পক্ষ থেকে আমরা সংস্থাটির কোড অব কনডাক্ট মেনে অনেকগুলো কেন্দ্র ভোট পর্যবেক্ষণ করেছি। বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোট প্রয়োগের দৃশ্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখেছি। ভোটের সরঞ্জামও দেখেছি। একটি কেন্দ্রে নারী ও তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি দেখে ভালো লেগেছে। ভোট কেন্দ্রে রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখেছি এবং তাদের সঙ্গে কথাও বলেছি। ভোট কেন্দ্রগুলোতে সার্বিক নিরাপত্তাসহ ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল।
রাজধানীর দারুস সালাম বাংলাদেশ কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ভোট পরিদর্শন শেষে জার্মান সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভলকার ইউ ফ্রেডরিক বলেন, স্বচ্ছ নিয়ম মেনে ভোট হচ্ছে। ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখিনি। আমরা এখানে ভোট দেখতে এসে খুশি। আমরা আরও অনেক ভোট কেন্দ্র ঘুরে দেখার বিষয়ে উদগ্রীব। ভোটের ফলাফল নিয়েও আমাদের আগ্রহ থাকবে।
ঢাকার একটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে চীনের এক পর্যবেক্ষক বলেন, ভোট শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে। ভোটের পরিবেশ ভালো।
ভোট পর্যবেক্ষণ করেছে নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশে ভোট দেখতে আসা ইইউয়ের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। তবে প্রতিনিধিদলটি এখনও তাদের অবস্থান জানায়নি। এছাড়া, সরকারি উদ্যোগে ভোট দেখতে আসা কমনওয়েলথ প্রতিনিধিদল ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। রোববার সন্ধ্যায় বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও কথা বলেননি জ্যামাইকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্রুস গোল্ডিংয়ের নেতৃত্বাধীন দলটি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, স্বতন্ত্র ৬২টি ও অন্যান্য দল থেকে আসন পেয়েছে দুইটি।
সূত্র : ঢাকা পোস্ট