উজ্জ্বল বড়ুয়া বাসু:
ভারতবর্ষের বুদ্ধগয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণগুলো খুঁজে দেখলে অন্যান্য কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে পাওয়া যায় ব্রাহ্মণদের নিপীড়ণ, অত্যাচার। ব্রাহ্মণরা এত বেশি অত্যাচার করেছেন যে হয় বৌদ্ধরা অঞ্চল ছেড়ে গেছেন নতুবা হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন।
বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণদের এত ক্ষোভের কারণ হচ্ছে- ব্রাহ্মণরা নিচু শ্রেণীর অন্য হিন্দুদের উপর বৈষম্য চালাতেন আর বুদ্ধ এই বর্ণবৈষম্যকে থামিয়ে দিয়ে সকল শ্রেণীর মানুষকে মানুষ হিসেবেই তুলে ধরেছেন। বুদ্ধের কাছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শুদ্র, বৈশ্য সবাই সমান-ই ছিলেন। বুদ্ধের কারনে নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও ব্রাহ্মণের সমান অধিকার পেয়েছেন তা ব্রাহ্মণরা কখনোই মানতে পারেননি। আর তাই ব্রাহ্মণদের ক্ষোভ সদা বৌদ্ধদের উপর বিরাজমান। আজ এতদিন পর এসেও সেই ক্ষোভ-ই যেন খুঁজে পাওয়া গেল ব্রাহ্মণ শিশির ভট্টাচার্য্যের লেখা দিয়ে।
ভারতে বর্তমান সময়ে দলে দলে দলিত হিন্দুরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করছে এটা যেন সইতেই পারছেন না অধ্যাপক মহোদয়। আর তাই তিনি বুদ্ধ পূর্ণিমা দিনে বিডিনিউজ24.কম এ “বুদ্ধপূর্ণিমায় ধর্মভাবনা: বৌদ্ধরা সব গেল কোথায়” শিরোনামে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন যেখানে তিনি বিকৃত, মনগড়া অসংখ্য তথ্য উপস্থাপন করে বুঝাতে চেয়েছেন বর্তমানে চট্টগ্রাম ব্যতীত ভারতবর্ষের কোথাও বৌদ্ধ নাই, চট্টগ্রামের বৌদ্ধরাও আর বেশি দিন বহাল তবিয়তে থাকবে না্। শুধু তাই নয় বুদ্ধকে নিয়েও তিনি নানা আপত্তিকর মন্তব্য তুলে ধরেছেন। আর তাই তার ভুলগুলো তুলে ধরতেই এ লেখার অবতারণা। লেখার শুরুতেই কৃতজ্ঞতা জানাতেই অমিতাভ সম্পাদক শ্যামল চৌধুরী’র প্রতি, তিনি-ই প্রথম আমাকে লেখাটি সম্পর্কে বলেছেন, সাথে লিখতে উৎসাহিত করেছেন। আমি পয়েন্ট আকারে ত্রুটি গুলো তুলে ধরলাম- শিশির ভট্টাচার্যের লেখার লিংক- http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/36198
১. লেখক শুরুটাই করেছেন অনুমান নির্ভর কথা দিয়ে; লিখেছেন- বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মস্তক মুণ্ডিত এবং মুখমণ্ডল ক্ষৌরিকৃত হবার একটি কারণ হয়তো এই যে উষ্ণ কিন্তু জলীয় বাষ্পবহুল বাংলা-বিহার অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের সূচনা……
অথচ বুদ্ধ স্পষ্ট করে ১৬টি কারণ (তৈল মাখা, ধৌত করা, বন্ধন করা, রং দেওয়া, চিরুনী ব্যবহার করা …ইত্যাদি) নির্দেশ করেছেন কেন তিনি চুল রাখতে নিষেধ করেছেন। (ত্রিপিটকের মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)। বুদ্ধ যেখানে কারণ নির্দেশপূর্বক বারণ করেছেন সেখানে লেখক মনগড়া কথা তুলে ধরেছেন জলীয় বাষ্পের কথা বলে।
২. তিনি লিখেছেন- ভারতবর্ষের এক চট্টগ্রাম ছাড়া আর কোথাও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী নেই। অখচ ভারতের কলকাতা, শান্তিনিকেতন, আসাম, লক্নৈৗ,হিমাচল, লাদাখ, অরুণাচল, মিজোরাম, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, কেরালা, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ; বিহার রাজ্যে এখনও বৌদ্ধরা আছেন। বিহার রাজ্যের ধম্মবিরিয় মহাথেরো একজন নির্বাচিত রাজ্যসভার সদস্য। উল্লেখিত প্রত্যেকটি অঞ্চলে বৌদ্ধদের নিজস্ব বৌদ্ধ বিহার(মন্দির)ও আছে।
বাংলাদেশের পটুয়াখালী, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চলেই বৌদ্ধরা আছে অথচ তিনি এক চট্টগ্রাম ছাড়া ভারতবর্ষের কোথাও বৌদ্ধদের খুজে পান না। এসব কি না জেনেই করেছেন নাকি বৌদ্ধদের সংখ্যায় নগণ্য দেখানোর জন্য মিথ্যাচার করেছেন কেবলমাত্র লেখকই বলতে পারবেন।
৩. বৌদ্ধরা চট্টগ্রামেও টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি । সেক্ষেত্রে তাকে বলতে হয় হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখবেন না। হিন্দুদের এক বাড়ী বাংলাদেশে থাকলে আরেক বাড়ি ভারতে থাকে, ব্যবসা বাণিজ্য শেষ হলে সুযোগ পেলেই তারা ভারতে পাড়ী জমায়। কিন্তু বৌদ্ধরা ব্যতিক্রম। ৭১ এর যুদ্ধের সময় হিন্দুরা ভারতে পলায়ন করলেও বৌদ্ধরা কিন্তু মায়ানমারে চলে যায় নি। আর তাই এখন নতুন করে চট্টগ্রাম থেকে হারিয়ে যাবে সে আশাও অমূলক।
৪. শিশির বাবু লিখেছেন- ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক, স্বর্গ-নরক, পুনরুত্থান ইত্যাদি সম্পর্কে বুদ্ধ নীরব থাকতেন। এটা একদম ডাহা মিথ্যা কথা।বুদ্ধ আত্মা সম্পর্কে অসংখ্য দেশনা প্রদান করেছেন, সুত্র পিটকের মধ্যম নিকায় গ্রন্থের সর্ব্বাসব সূত্র তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ।তাছাড়া বৌদ্ধ ধর্মের মূলেই তো রয়েছে অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মা। তাহলে বুদ্ধ আত্মা সম্পর্কে নীরব রইলেন কিভাবে?
সুত্ত পিটকের দেবদূত সূত্র পড়লে বুঝা যায় বুদ্ধ পরলোক এবং পুনরুত্থান সম্পর্কে কিভাবে স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। তাছাড়া বুদ্ধ চতুষ্মাহারাজিক স্বর্গ, তাবতিংস স্বর্গ, তুষিত স্বর্গ… ইত্যাদি; সঞ্জীব, কালসুত্ত, সঙ্ঘাত, রোরুব …. ইত্যাদি নরকের বিবরণ দিয়েছেন। তাহলে এটাই প্রমাণিত হয় তার কথাগুলো কেবল মনগড়া কল্পকাহিনী।
এটা ঠিক যে, বুদ্ধ শুধুমাত্র ব্যক্তি ঈশ্বর সম্পর্কে নীরব থেকেছেন তাই বলে মানবের উৎপত্তি, পুনরুত্থান ইত্যাদি এড়িয়ে যান নি প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি-ই হচ্ছে তার বড় প্রমাণ। বুদ্ধ যা করেননি তা হচ্ছে মানবজাতিকে ব্যক্তি ঈশ্বরের মুখাপেক্ষী করে রাখা।
৫. ভিক্ষুদের জীবনাচার নিয়েও তিনি মনগড়া কথা তুলে ধরেছেন- বুদ্ধ কোথাও বলেননি ভিক্ষুরা একবার মাত্র খাদ্য গ্রহণ করবে, এক বাড়িতে পরপর দুই দিন ভিক্ষান্নে যেতে পারবেনা এমন নিষেধাজ্ঞাও ভিক্ষু বিনয়ের কোথাও নাই। শিশিরবাবু লিখেছেন ভিক্ষান্ন যাই হোক- গরুর মাংস, বরাহ মাংস…তাই গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অথচ তিনি জানেন-ই না বুদ্ধ দশ প্রকার মাংস নিষিদ্ধ করেছেন ভিক্ষুদের। এমনকি মনে সন্দেহ আসলে অন্য মাংস বা মাছও তারা খেতে পারেন না।
৬. লেখকের লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, কেউ একজন বুদ্ধ পূর্ণিমার একটা প্রবন্ধ দিতে বলেছে আর তিনি বিভিন্ন বইয়ের এখান থেকে দুলাইন ওখান থেকে দুলাইন সংযোজন করেছেন । লবণ সঞ্চয়, আর দশ নিয়ম (দশ মহাবস্তু) নিয়ে যে মতান্তর হয়েছিল তা তো বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণেরও একশত বছর পরের ঘটনা। আর তিনি তা বুদ্ধের সময়কালীন দেবদত্তের কাহিনীতে এনে যোগ করে ইতিহাসের বিকৃতি সাধন করেছেন।
৭. বুদ্ধের জীবৎকালে ব্যভিচার নিযে সঙ্ঘ ভাঙ্গার উপক্রমের কাহিনীগুলো কোথায় পাওয়া যায় না যা তিনি লিখেছেন। আরো লিখেছেন- পাপী যদি অনুতপ্ত হতো তবে তাকে সঙঘ থেকে বহিস্কার না করার প্রশ্নে অনড় থাকতেন। অথচ বুদ্ধের জীবিত কালীন সময়েই পারাজিকা প্রাপ্ত দুঃশীল ভিক্ষুদের সঙ্ঘ থেকে বহিস্কারের নজির পাওয়া যায় অনেক। এমনকি বুদ্ধের সামনেই তাদের ভিক্ষুসীমা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। (বিনয় পিটকের মহাবর্গে গ্রন্থেই এসব প্রমাণাদি পাওয়া যায়।) অতএব তার কথাগুলো আবারও মনগড়া-ই প্রমাণিত হয়।
৮. বুদ্ধের সময়ে কেবলমাত্র দেবদত্তই কিছু বিষয়ে নিজের কর্তৃত্ব নেওয়ার জন্য বিরোধিতা করেছিলেন যে কিনা মৃত্যুর পূর্বে বুদ্ধের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরকম অন্য কোন নেতা পাওয়া যায় না, শিশির বাবু নাম উল্লেখ না করে আরো অনেক নেতার কথা বলেছেন যা ত্রিপিটকে পাওয়া যায় না। তদুপনর জাতিভেদ, শ্রেণীভেদকে এনে এমনভাবে বুঝাতে চেয়েছেন যেন বুদ্ধের বিরোধী ৫-১০টা গ্রুপ ছিল সঙ্ঘের মধ্যে। লেখকের জানা উচিত তৎকালীন হিন্দুদের জাতিভেদ, শ্রেণীভেদ রুখে দিয়েই বৌদ্ধ ধর্মের সৃষ্টি অতএব সেই বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তিকালীন সময়ে আপনার ধারণাগুলো কেবল অমূলক বৈ কিছু নয়।
৯. হিন্দুরা বুদ্ধের উত্থানকে কখনোই মানতে চায় নি। তাই তারা তাকে অবতার/দেবতা সাজিয়ে নিজেদের একজন বলেই প্রকাশ করেছেন সবসময়। লেখকও তার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের উধ্বে যেতে পারেন নাই। এজন্যই তিনি বারবার বুদ্ধ দেব বলে বুদ্ধকে দেবতা সাজাতে চেয়েছেন। মূলতঃ বুদ্ধ একজন মানুষ-ই, দেবতা নন।
১০. বুদ্ধের সময় ঘড়ি-ই ছিলনা- অথচ আপনি লিখেছেন এক ভিক্ষু বলেছেন বুদ্ধ না থাকায় এখন আর ঘড়ি ধরে বিনয় পালন করতে হবে না্। যেখানে ঘড়ি-ই নেই সেখানে ঘড়ির কথা একজন ভিক্ষু বলেন কিভাবে? এসব কল্পিত উদাহরণ কি কেবল তার-ই সৃষ্ঠি?
১১. বুদ্ধের জীবিতকালীন সময়েই মূর্তিপুজা চালু হয়, সুত্তপিটকের বট্টাঙ্গুলি জাতক তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আর তিনি মনগড়া কথা লিখেছেন বুদ্ধের পরিনির্বাণের কয়েক শত বছর পর মূর্তিপুজা চালু হয়েছে বলে। তিনি স্তুপ পূজা নিয়েও বিকৃত তথ্য দিয়েছেন।বুদ্ধ জীবিতকালীন সময়েই সারিপুত্র ও মৌদগল্যায়ন স্থবিরের দেহধাতু দিয়ে ধাতুচৈত্য স্তুপ নির্মাণ করে পূজা শুরু করেন মহাপরিনির্বাণ সূত্রে যা দৃষ্ট হয়। এক্ষেত্রেও শিশির বাবু তা বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে বলে বিকৃতি ঘটিয়েছেন।
১২. লেখক তার লেখায় আট বার সম্ভবত আর হয়তো শব্দ দুটির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আর এই সম্ভবত দিয়েই বৈঞ্চব আর বাউল গোষ্ঠীর উদ্ভব দেখিয়েছেন। একটি জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব কি অনুমান নির্ভর হয়ে সম্ভবত এর ব্যবহার দ্বারা দেখানো যায় গবেষণা ব্যতীত? তিনি কিন্তু পেরেছেন তাই তো লিখেছেন- এদের একটি অংশ সম্ভবত বৈঞ্চব এবং/অথবা বাউলে রুপান্তরিত হয়েছিল।
১৩. সর্বশেষ তার দৈন্যতা দেখে অবাক হই- তিনি কেবল বাউলের মাঝেই বৌদ্ধদের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন? আমেরিকা, ইউরোপ এর নানা জায়গায় বৌদ্ধ ধর্মের যে কি হারে প্রসার ঘটছে তা কি তিনি আসলেই জানেন না? নাকি না জানার ভান ধরে চোখ বুজে আছেন? অল্প কয়দিন আগেও ভারতে কতগুলো হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেন তা কি খবরে পাচ্ছেন না? নাকি তাতেও বধিরের ভাব দেখাবেন?
পরিশেষে তাই ব্রাহ্মণ শিশির ভট্টাচার্য্যের উদ্দেশ্যে বলতে ইচ্ছে করে- বৌদ্ধরা আছে বীরদর্পে সারাবিশ্বে, তারা থাকবে। আর আপনাকে অনুরোধ জানাই ত্রিপিটকের বিভিন্ন গ্রন্থগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। এখন তো সহজেই নেট এ বাংলা ত্রিপিটক খুঁজে পাওয়া যায়। আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই-
আর তা যদি হয় তবে আপনার কলম দিয়ে অন্ততঃ আর নতুন করে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন হবে না। শিশির ভট্টাচার্য্য নামে বাংলাদেশে হাজার খানেক ব্যক্তি থাকতে পারে কিন্তু আপনি তাদের থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। আপনার পদবীর কারণেই মানুষ আপনাকে ভিন্ন চোখে দেখে। আপনি যা লিখেন তা-ই অন্তত ৯০% মানুষ সাদরে গ্রহণ করে নেয়, বিশ্বাস করে। তাই সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার জন্য হলেও আপনার অধিকতর সচেতন হয়ে যে কোন কিছু প্রকাশ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। নতুবা শান্তপ্রিয় বৌদ্ধরা কেবল কলম ধরেই বসে থাকবেনা্। নতুন আইনে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে আপনাকে আদালতে তুলতেও দ্বিধাবোধ করবেনা।
লেখক– সরকারি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা।